একজন পুণ্যবতী নারী
উম্মে এমদাদ
[এ প্রবন্ধের লেখিকা উম্মে এমদাদ একজন দ্বীনী জ্ঞানসম্পন্ন, অল্পে তুষ্ট, দানশীল ও ইবাদতগুজার নারী ছিলেন। বিগত পহেলা আগস্ট ২০২১ তাঁর আম্মা ইন্তেকাল করেন। আগস্ট মাসেই তিনি বক্ষ্যমাণ নিবন্ধটি লেখেন। লেখাটি তাঁর ছোটো ছেলে পরিমার্জন ও কম্পোজ করে তাঁকে দেন। তিনি লেখাটি বহুবার পড়েছেন এবং বলেছেন, তাঁর মা প্রসঙ্গে পুনরায় আরও বড় করে লিখবেন। এরমধ্যেই মহিয়সী এ লেখিকা গত ৮ ডিসেম্বর ২০২১ বুধবার আল্লাহ তাআলার প্রিয় হয়ে গেছেন। মৃত্যুকালে লেখাটি তাঁর হাতের কাছে ছিল। আমরা লেখিকা এবং তাঁর মায়ের জন্য জান্নাতুল ফিরদাউস কামনা করি।]
আজ একজন মহীয়সী নারীর কথা বলব। আশা করি, পাঠক এর থেকে উপকৃত হবেন। বিশেষ করে আমার ভাই-বোন, সন্তান ও আত্মীয়স্বজন বুঝতে পারবেন, একজন নারী সংসারের সকল কাজ আঞ্জাম দিয়েও কত সুন্দর জীবনযাপন করতে পারেন। কতটা উপকারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন—
الدُّنْيَا كُلُّهَا مَتَاعٌ، وَخَيْرُ مَتَاعِ الدُّنْيَا الْمَرْأَةُ الصَّالِحَةُ.
‘গোটা দুনিয়াই উপকার অর্জনের বস্তু, আর দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ উপকার অর্জনের বস্তু হল নেককার নারী।’
এ লেখার নেককার নারী হলেন কুমিল্লা কাসেমুল উলূম মাদরাসার সাবেক শাইখুল হাদীস আল্লামা আশরাফ উদ্দীন রাহ. -এর সহধর্মিণী, আমার শ্রদ্ধেয় আম্মাজান রাহমাতুল্লাহি আলাইহা। আল্লাহ তাআলা তাঁর সকল ভালো কাজ কবুল করুন এবং আমাদেরকে তা থেকে উপকৃত হওয়ার তাওফীক দান করুন।
বিবাহ ও সাংসারিক জীবন
আম্মা অত্যন্ত বিত্তশালী পরিবারে বেড়ে ওঠেন। আমার নানারা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ছিলেন। অর্থ-বিত্তের কোনো অভাব তাঁদের ছিল না। সে তুলনায় আব্বার আর্থিক অবস্থা ছিল তাঁদের থেকে নিচে। তবে বংশপরম্পরায় আলেম খান্দান হওয়ায় এ খান্দানের ঐতিহ্য ছিল। একবার আমার নানা স্বপ্নে দেখেন, সমুদ্রে একটি স্বর্ণের টুকরা ভেসে যাচ্ছে। টুকরাটি সংগ্রহের জন্য নানা আম্মাকে সমুদ্রে ফেলে দিয়েছেন।
নানা তাঁর বড় ভাই, কুমিল্লা কাসেমুল উলূমের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা জাফর সাহেবের নিকট এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চান। মাওলানা জাফর সাহেব বলেন, ‘হয়তো তোমার মেয়ের বিবাহ হবে কোনো আলেমের সঙ্গে, বৈবাহিক জীবনে অনেক পরীক্ষা আসতে পারে। দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে পড়ালেখা করে আসা কোনো যোগ্য আলেমের সন্ধান কর।’
আব্বা তখন কুমিল্লার বরুড়া মাদরাসার মুহাদ্দিস। যেহেতু তাঁর পরিবারে অর্থসম্পদের সমারোহ ছিল না, তাই নানাদের সংশয় ছিল এ মেয়ে এ পরিবারে টিকতে পারবে কি না! আল্লাহর হুকুমে বিবাহ হল। আম্মা ৭০ টি বছর কাটিয়ে দিলেন শান্তিতে, সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে। কোনো দিন কোনো বিষয়ে অভিযোগ করেননি। আলেম পরিবারের সংস্পর্শে এসে উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পান। তিনি বুঝতে পারেন, প্রকৃত শান্তি অর্থবিত্তের প্রাচুর্যে নয়, বরং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যে। না পাওয়ার কোনো বেদনা ছিল না আম্মার জীবনে। যা পেতেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকতেন। সর্বাবস্থায় আল্লাহর শোকর আদায় করতেন। বিপদে-আপদে আম্মা বেশি বেশি বলতেন আলহামদু লিল্লাহি আলা কুল্লি হাল। সবর ও শোকরের অনন্য দৃষ্টান্ত ছিল আম্মার জীবন।
কাজকর্ম ও স্বাস্থ্যসচেতনতা
আম্মা ছিলেন কর্মনিষ্ঠ ও কর্তব্যপরায়ণ। আমার বুঝ হওয়ার পর থেকে দেখেছি সংসারের সকল কাজ আম্মা নিজ হাতে করতেন। দাদা-দাদির খুব খেদমত করতেন। যেকোনো প্রয়োজনে দাদা-দাদিও আম্মাকে ডাকতেন। আম্মার স্বতঃস্ফূর্ত খেদমত দেখে দাদা-দাদি আম্মার জন্য দুনিয়া-আখেরাতের কল্যাণের দুআ করতেন। আব্বা যেহেতু মাদরাসা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, তাই আমাদের ভাই-বোনদের সকল খোঁজ-খবর আম্মাই রাখতেন। শত ব্যস্ততা সত্তে¡ও তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ পরিপাটি থাকত। বার্ধক্যে এসেও তিনি নিজের কাজগুলো নিজে করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। স্বাস্থ্যের ব্যাপারে তিনি খুবই সচেতন ছিলেন। পরিমিত খাবার খেতেন। খাবার-দাবার ও পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারে অল্পেতুষ্টি ছিল তাঁর জীবনের বড় বৈশিষ্ট্য।
স্বামীর আনুগত্য ও খেদমত
আম্মা অত্যন্ত ভক্তি-শ্রদ্ধার সাথে আব্বার খেদমত করতেন। আব্বার কোনো কাজ অন্য কাউকে করতে দিতেন না, এমনকি আমাদেরকেও না। প্রতি বৃহস্পতিবার বিকালে আব্বা মাদরাসা থেকে বাড়ি আসতেন, শনিবার সকালে চলে যেতেন। আম্মা এমনিতেই বেশ পরিপাটি ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিলেন, আব্বার বাড়ি আসাকে কেন্দ্র করে ঘর-দোর, উঠান-বাড়ি গুছিয়ে, আব্বার পছন্দনীয় খাবার তৈরি করতেন। আম্মা-আব্বার মাঝে কখনো কথা কাটাকাটি বা মনোমালিন্য আমরা দেখিনি। আব্বার কষ্ট হবে এমন কোনো প্রসঙ্গ আম্মা উঠাতেন না। আব্বা বাড়ি এলে আম্মা নফল ইবাদত কম করতেন; বরং আব্বার খেদমত করাই তিনি নেক আমল মনে করতেন। আব্বা জীবিত থাকা অবস্থায় আম্মা কোনো সময় এতেকাফ করেননি। আব্বার ইন্তেকালের পর আম্মা ২১ বছর জীবিত ছিলেন। এই ২১ বছরের মধ্যে এক বছরও তিনি এতেকাফ ছাড়েননি।
স্বামীভক্তির যে দৃষ্টান্ত তিনি দেখিয়েছেন তা থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। একবার আম্মা ছিলেন নানার বাড়িতে। ইতিমধ্যে আম্মার এক চাচাতো বোনের বিবাহ ঠিক হল। আম্মার সে চাচার বাড়িও পাশেই। নানাদের ঘরের সবাইকে দাওয়াত করা হল। সে অনুষ্ঠানে সবাই গেলেন, কিন্তু আম্মা গেলেন না। কারণ তিনি স্বামীর অনুমতি নেয়ার সুযোগ পাননি। স্বামীর অনুমতি ছাড়া তিনি কোথাও যাবেন না। দ্বীনদার শ্রেণির নিকট বিষয়টি স্বাভাবিক হলেও সেদিনের অনুষ্ঠানের অনেকে এটিকে ভিন্নভাবে দেখে। কিন্তু আম্মা কোনো কিছুরই পরোয়া করেননি। আল্লাহর কী মহিমা, কোনো রুটিন ছাড়াই নানার বাড়িতে আব্বা এসে উপস্থিত। সকল ঘটনা শুনে আব্বা অনেক খুশি হন এবং আম্মার জন্য অনেক দুআ করেন। এরপর আব্বা নিজেই আম্মাকে নিয়ে দাওয়াতে শামিল হন। এতে বাড়ির সবাই খুব খুশি হন।
আম্মার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে আব্বা প্রায় সময় এই বলে দুআ করতেন, ‘আল্লাহ তোমার জন্য জান্নাত ওয়াজিব এবং জাহান্নাম হারাম করে দিন।’
আত্মীয়তা রক্ষা ও মেহমানদারী
আত্মীয়তা রক্ষার ব্যাপারে তিনি অত্যধিক যত্নশীল ছিলেন। ছোট-বড় সবার খোঁজখবর রাখতেন। কারো অসুস্থতার খবর পেলে বারবার তাঁর অবস্থা জানতেন। সবার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার ব্যাপারে তাঁর অবস্থা এমন ছিল যে, ছেলে-মেয়ে নাতি-নাতনি এবং তাদের সন্তানদের সম্পর্কেও তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে তৎক্ষণাৎ তিনি বলে দিতে পারতেন কার অবস্থা কেমন।
আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর রাখার ব্যাপারে তিনি ছিলেন যেমন সচেতন, তেমনই আতিথেয়তা ও মেহমানদারীর ব্যাপারেও ছিলেন অনন্য সাধারণ। আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশী সকলেই তার এই ব্যাপারটি জানত। আত্মীয়স্বজন তো বটেই এমনকি আব্বার কোনো ছাত্র কখনো এলে তাদের মেহমানদারীর ব্যবস্থাও খুব যত্নের সাথে করতেন। ঘরে যা থাকত তা দিয়ে মেহমানদারী করতে তিনি সংকোচবোধ করতেন না।
তিনি বলতেন, হঠাৎ কোনো মেহমান এলে, ভালো খাবার নেই— এই চিন্তায় মেহমানদারী না করা কিংবা মেহমানদারী করতে বিলম্ব করা উচিত নয়। বরং তোমার সামর্থ্যে যা আছে তাই মেহমানের সামনে উপস্থিত কর। তোমার কাছে কোনো খাবার সাধারণ মনে হলেও, হয়ত এটিই মেহমানের প্রয়োজন পূরণ করবে। তাই সময় ও সামর্থ্য থাকলে মেহমানের জন্য ভালো খাবারের ব্যবস্থা কর, অন্যথায় যা আছে তা দিয়েই নিঃসংকোচে মেহমানদারী কর। আমরা দেখেছি, অল্প সময়ের জন্য কেউ দেখা করতে এলেও তিনি হাতের কাছে যা থাকত তা-ই সামনে পরিবেশন করে দিতেন। আম্মার জন্য কখনো যদি কেউ ফল-মূল বা অন্য কোনো খাবার নিয়ে আসত, তিনি তা সাথে সাথে বাড়ির সদস্য ও প্রতিবেশীদের মাঝে বণ্টন করে দিতেন।
দান-সদকা ও পরোপকার
সুযোগ হলেই আম্মা দান-সদকা করতেন। সদকার ব্যাপারে তাঁর বিশেষ গুরুত্ব দেখেছি। রোগ-বিমারী, বালা-মুসীবত ও সব ধরনের পেরেশানিতে তিনি সদকা করতেন। আমাদেরও বলতেন, বেশি বেশি সদকা করবে। আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
إنَّ الصَّدَقَةَ لَتُطْفِئُ غَضَبَ الرَّبِّ وَتَرُدُّ الْبَلَاءَ.
দান-সদকা আল্লাহর ক্রোধ প্রশমিত করে এবং বালা-মুসিবত দূর করে।
কোনো সমস্যার ব্যাপারে আম্মাকে অবগত করলে বলতেন, কিছু সদকা করে দাও, ইনশাআল্লাহ ঠিক হয়ে যাবে। সদকাকে তিনি চিকিৎসারই অন্তর্ভুক্ত মনে করতেন।
পরোপকারের অনন্য দৃষ্টান্ত আম্মার জীবনে অনেক রয়েছে। একবারের ঘটনা। ১৯৭৪ সাল। দেশে তখন প্রচণ্ড অভাব। আশপাশের অনেকেই আমাদের বাড়ি আসত কিছু খাবারের জন্য। আমরা তখন নিজেরা চলতে পারলেও আশপাশের লোকদেরকে সহযোগিতা করার মতো অবস্থা ছিল না। তবে অনাহারী ক্ষুধার্ত লোকদের মুখে অন্ন যোগাতে আম্মা ব্যাকুল হয়ে যেতেন। ভেবেচিন্তে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। আশপাশের অধিক বিপদগ্রস্ত লোকদের আমাদের বাড়ি আসার জন্য খবর দেয়া হল। আমার মামারা যেহেতু বিত্তবান এবং প্রচুর ফসলি জমির মালিক তাই আম্মা নানার কাছে একটি চিঠি লিখে দেন যে, ‘এরা অভাবগ্রস্ত। এদেরকে যেন ধান দিয়ে সহযোগিতা করা হয়।’
চিঠি নিয়ে তারা মামাদের বাড়ি গেলেন। আম্মার চিঠি পড়ে নানাজী আফসোস করে বললেন, ‘হায় আমি তো সব ধান বিক্রি করে দিয়েছি। তারপরও যেহেতু প্রচুর ধান হত, তাই তাদের ধানের গোলাসমূহ ঝেরে ধান বের করে নিতে বললেন।’
সেদিন তারা সাত মণ ধান পেয়েছিলেন। নানাজী তাদেরকে ধানগুলো নিয়ে যেতে বললেন এবং কন্যার চিঠি পেয়ে উপযুক্ত পরিমাণ দিতে পারেননি বলে আফসোস করলেন। লোকেরা ধানগুলো আমাদের বাড়ি নিয়ে এলে আম্মা তাদেরকে ভাগ করে নিতে বললেন। যার কিছু নেই তার কাছে সামান্য বস্তুও অনেক দামি। সেদিন আমাদের এলাকার অনেক লোক মিলে ধানগুলো ভাগ করে নিয়েছিল এবং খুশি হয়ে আম্মার জন্য দুআ করেছিল।
চিকিৎসা সেবা
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় আম্মার বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল। নিজের ও ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিদের প্রাথমিক চিকিৎসা তিনিই করতেন। এলাকার নারী—শিশুদেরও তিনি বিনা পয়সায় হোমিওপ্যাথির চিকিৎসা করতেন। বিশেষ করে গর্ভবতী, প্রসূতি ও নবজাতকের চিকিৎসায় তাঁর হাতের যশ ভালো ছিল। পাড়া-প্রতিবেশী মহিলারা নিজেদের বা সন্তানদের অসুখ-বিসুখসহ নানান সমস্যায় চিকিৎসা কিংবা পরামর্শের জন্য যেকোনো সময় তাঁর কাছে ছুটে আসত। তিনিও তাদেরকে যত্নের যত্নের সঙ্গে সেবা ও সুপরামর্শ দিতেন।
জ্ঞানচর্চা
জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি জ্ঞানচর্চা অব্যাহত রেখেছিলেন। বার্ধক্যে এসেও তিনি কুরআন ও হাদীসের বিভিন্ন বাণী, শিক্ষণীয় উপদেশ, কবিতা পঙ্ক্তি ইত্যাদি ডায়েরিতে নোট করে রাখতেন। এমন একটি ডায়েরি বর্তমানে আমার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। তাঁর হাতের লেখা বেশ সুন্দর ও পরিষ্কার ছিল। নিয়মিত তিনি বিভিন্ন বই পড়তেন। বিশেষ করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাত, মহিলা সাহাবীদের ঈমানদীপ্ত ঘটনাবলি, আকাবিরের জীবনী, স্মারকগ্রন্থ ও স্মরণীয় মনীষীদের ইতিহাস সবসময় পড়তেন। এছাড়াও হোমিওপ্যাথির গ্রন্থাবলি, বিশ^নবীর চিকিৎসা বিধান, বেহেশতী জেওরসহ আরও অনেক বই-পুস্তক তাঁর নিয়মিত পাঠের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
বাইতুল্লাহর প্রতি ভালবাসা
বাইতুল্লাহ শরীফের প্রতি তাঁর ভালবাসা ছিল অপরিসীম। তিনি বাইতুল্লাহর সফরের জন্য ব্যাকুল ছিলেন। প্রায় সময় দুআ ও মুনাজাতে কান্নাকাটি করতেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আম্মার দুআ কবুল করেছেন। আমার স্নেহের ছোট ভাই জাফর আহমদকে নিয়ে তিনি হজ্জ পালন করেন। হজ্জ থেকে ফেরার পর মক্কা-মদীনার প্রতি তাঁর মহব্বত আরও বেড়ে যায়। সময় সুযোগ পেলেই সেখানকার আলোচনা করতেন। দুআ করতেন আত্মীয়স্বজন, পরিচিতজন সকলকে যেন আল্লাহ তাআলা মক্কা-মদীনার বরকত লাভ করার তাওফীক দান করেন।
আমার ওমরায় যাওয়ার সময় আম্মা বলেছিলেন, মক্কায় থাকা অবস্থায় বেশি বেশি পড়বে—
لا إله إلا الله الملك الحق المبين.
আর মদীনায় বেশি বেশি দরূদ শরীফ পড়বে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজায় আমার সালাম পৌঁছে দিয়ো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুই সাথী আবু বকর রা. ও ওমর রা.কেও আমার সালাম দিয়ো। মক্কা ও মদীনার কথা বলার সময় আম্মা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়তেন। মক্কা-মদীনার প্রতি এই একনিষ্ঠ ভালবাসা আল্লাহ কবুল করুন।
আম্মা আরও বলেছিলেন, একাধিক বোরকা নিয়ো। কারণ তাওয়াফ ও সাইয়িতে বোরকা ময়লা হলে ধোয়ার সময় কম। আম্মার কথা অনুযায়ী একাধিক বোরকা নিয়েছিলাম। অনেক সুবিধা হয়েছে।
ইবাদত-বন্দেগী
আম্মা নিভৃতে আল্লাহর ইবাদত করতেন। আওয়াল ওয়াক্তে নামায আদায় করতেন। জীবনে কখনো তাঁর নামায কাজা হয়নি। ফরয, ওয়াজিবের পাশাপাশি অধিক পরিমাণে নফল ইবাদত করতেন। নিয়মিত ইশরাক, চাশ্ত, আওয়াবিন ও তাহাজ্জুদ নামায আদায় করতেন। প্রতি শুক্রবার সালাতুত তাস্বীহ পড়তেন। রমযান মাসে আম্মা মানবীয় প্রয়োজন ছাড়া রাত-দিনের পুরো সময়ে ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকতেন। অযথা কথাবার্তা ও গল্পগুজব নিজেও করতেন না, কেউ করলে তা পছন্দ করতেন না। সকল নফল রোযা আদায় করতেন। যিলহজে¦র রোযা, শাওয়ালের রোযা, মুর্হারমের রোযা, সোম ও বৃহস্পতিবারের রোযা নিয়মিত রাখতেন। তিনি বলতেন, রোযা রাখলে আমার শরীর ভালো থাকে।
তিলাওয়াত ও মুনাজাত
আম্মা প্রতিদিন দীর্ঘ সময় কুরআনুল কারীম তিলাওয়াত করতেন। সূরা ইয়াসীন, সূরা ওয়াকিয়া, সূরা মুল্কসহ অনেক সূরা তাঁর মুখস্থ ছিল। পরিবার-পরিজনের সকলকে আমলী সূরাসমূহ মুখস্থ করানোর ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করতেন। প্রতি শুক্রবার সূরা কাহফ তিলাওয়াত করতেন। দৈনন্দিন আমলী সূরাসমূহ তিলাওয়াত করার সাথে সাথে রুটিন করে খতমের নিয়তে কুরআনুল কারীম তিলাওয়াত করতেন। তিনি দরূদ শরীফের আমল অনেক বেশি করতেন। আমাদেরকেও বলতেন অধিক পরিমাণে দরূদ শরীফ পড়ো। এতে অনেক বরকত পাবে। হাদীস শরীফে আছে, একবার দরূদ শরীফ পাঠ করলে ১০ টি গোনাহ মাফ হয় এবং ১০ বার আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়।
আম্মার অনেক দুআ জানা ছিল। সকাল-সন্ধ্যার মাসনূন দুআগুলো গুরুত্বের সাথে পড়তেন। প্রতিদিন মুনাজাতে মাকবুল পাঠ করতেন। আমাদেরকেও কুরআনে কারীম তিলাওয়াত, মাসনূন দুআ ও মুনাজাতে মাকবুল পড়তে বলতেন।
সুন্দরতম বিদায়
পহেলা আগস্ট ২০২১ শনিবার। অন্যান্য দিনের মতোই আম্মা সকল কাজ করেছেন। ফজর ও ইশরাকের নামায আদায়, সূরা ইয়াসীন তিলাওয়াত ও অন্যান্য ওজীফা পাঠ সবকিছুই তিনি স্বাভাবিকভাবেই করেছেন। সাধারণত আম্মা সকাল দশটা-এগারোটার দিকে মুনাজাতে মাকবুল পড়া শেষ করে খতমের জন্য কুরআনুল কারীম তিলাওয়াত করেন। আজও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। তিলাওয়াত শেষ করে আম্মা কুরআনুল কারীমের গিলাফ লাগিয়ে তা রাখতে যাবেন এমন সময় আমার বড় ভাইয়ের বড় ছেলে জুনায়েদ আম্মার ঘরে প্রবেশ করে। আম্মা জুনায়েদকে ডেকে বললেন, ‘আমাকে ধরো, আমার শরীর কেমন যেন শক্তিহীন হয়ে আসছে।’
জুনায়েদ আম্মাকে ধরে খাটের ওপর শোয়ায়। আম্মা বললেন, ‘আমার মাথা উত্তর দিকে করে দাও, হয়তো আমার সময় শেষ। তোমার চাচা ও ফুফুদের খবর দাও। ওরা হয়তো আমাকে আর জীবিত দেখবে না।’
এ সময় আরও বলেন, ‘আমাকে কোনো পুরুষ ডাক্তারের কাছে নেবে না। নিলে তোমরা গোনাহগার হবে।’
যদিও অসুস্থ ব্যক্তির জন্য পুরুষ ডাক্তারের কাছে যাওয়ার অনুমতি রয়েছে, কিন্তু এটা তাঁর জীবনের প্রত্যয় ছিল। আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দীর দিলের এই আবেগ কবুল করেছেন। গোটা জীবনে তাঁকে সরাসরি কোনো ডাক্তারের কাছে নিতে হয়নি। যেকোনো সমস্যায় হোমিওপ্যথি ওষুধের মাধ্যমে নিজেই নিজের চিকিৎসা করতেন। আর একান্ত প্রয়োজন মনে হলে আম্মার মামাতো ভাই অধ্যাপক মবিন খানের সাথে ফোনে কথা বলতেন। অধ্যাপক মবিন খান আম্মার অন্তত ১০ বছরের ছোট।
আম্মা বিছানায় শুয়ে বিভিন্ন দুআ-দরূদ পাঠ করছিলেন। সব শেষে পাঁচ বার লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ পাঠ করেন। তারপর তাঁর মুখের আওয়াজ ও নিশ্বাস থেমে যায়। পরিসমাপ্তি ঘটে দুনিয়ার সফরের। আম্মা চলে যান রফিকে আ‘লার সান্নিধ্যে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। ওফাতের সময় তাঁর বয়স হয় ৮৭ বছর।
আম্মা সবসময় দুআ করতেন আল্লাহ তাআলা যেন তাকে আরজালুল উমর বা হীনতম বয়সে উপনীত হওয়া থেকে পানাহ দান করেন এবং তাঁকে অন্যের গলগ্রহ না করেন। আল্লাহ তাআলা আম্মার এই দুআও কবুল করেছেন। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি নিজের কাজ নিজেই করেছেন। কোনো নামায তাঁর কাজা হয়নি, এমনকি নফল অজীফা পর্যন্ত কাজা হয়নি। কত সুন্দরভাবে পৌঁছেছেন আপন গন্তব্যে।
হে আল্লাহ! আম্মার কবরকে আরামদায়ক শীতল করে দিন। যেদিন আপনার আরশের ছায়া ব্যতীত আর কোনো ছায়া থাকবে না, সেদিন আপনার আরশের ছায়াতলে আমার আম্মাকে স্থান দান করুন— আমীন।