মাসআলা-মাসায়েল
মাসআলা : ওযুতে মিসওয়াক করা সুন্নত।
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন—
لَوْلَا أَنْ أَشُقَّ عَلَى أُمَّتِي، لَأَمَرْتُهُمْ بِالسِّوَاكِ مَعَ الْوُضُوءِ.
আমার উম্মতের উপর অধিক কষ্টের আশঙ্কা না হলে আমি তাদের উপর প্রত্যেক ওযুর সময় মিসওয়াক আবশ্যক করে দিতাম। —মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯৯২৮
মিসওয়াকের সুন্নতটি পুরুষ মহিলা সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এছাড়া একটি হাদীসে হযরত আয়েশা রা. থেকে সুস্পষ্টভাবেই মিসওয়াক করা প্রমাণিত আছে। সুনানে আবু দাউদে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন—
كان نبيُّ الله صلى الله عليه وسلم يَستاكُ فيُعطيني السِّواكَ لأغسِلَه، فأبدأُ به فأستاكُ، ثمَّ أغسِلُه وأدفَعُه إليه.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিসওয়াক করে ধোয়ার জন্য আমাকে দিতেন। আমি নিজে প্রথমে তা দিয়ে মিসওয়াক করতাম অতঃপর ধুয়ে তাঁকে দিতাম। —সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫২
মিসওয়াকের ব্যাপারে ব্যাপকভাবে উদাসীনতা লক্ষ করা যায়। বিশেষত মহিলাদের মাঝে উদাসীনতার মাত্রা আরও অধিক, যা কাম্য নয়। এ সুন্নতটির প্রতি যত্নবান হওয়া কর্তব্য।
মাসআলা : ওযুতে হাত পায়ের আঙ্গুল খিলাল করা সুন্নত। হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন—
إِذَا تَوَضَّأْتَ فَخَلِّلِ الْأَصَابِعَ.
ওযু করলে আঙ্গুল খিলাল করবে। —জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৮
বিশেষ করে পায়ের আঙ্গুল মিলে মিলে থাকার কারণে স্বাভাবিকভাবে দুই আঙ্গুলের ফাঁকে পানি না পৌঁছার আশঙ্কা বেশি থাকে তাই পায়ের আঙ্গুল খিলালের প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া কর্তব্য। মুসতাওরিদ ইবনে শাদ্দাদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন—
رأيتُ رسولَ الله صلى الله عليه وسلم إِذَا تَوَضَّأَ خَلَّلَ أَصَابِعَ رِجْلَيْهِ بِخِنْصَرِهِ.
আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ওযুর সময় তাঁর কনিষ্ঠা আঙ্গুল দ্বারা পায়ের আঙ্গুল খিলাল করতে দেখেছি। —মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৮০১০
মাসআলা : ফরয গোসলে মহিলাদের জন্য চুলের বেনী খোলা জরুরি নয়; বরং চুলে বেণি করা থাকলে চুলের গোড়ায় পানি পৌঁছানোই যথেষ্ট।
عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ، قَالَتْ: قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ إِنِّي امْرَأَةٌ أَشُدُّ ضَفْرَ رَأْسِي فَأَنْقُضُهُ لِغُسْلِ الْجَنَابَةِ؟ قَالَ: لَا. إِنَّمَا يَكْفِيكِ أَنْ تَحْثِي عَلَى رَأْسِكِ ثَلَاثَ حَثَيَاتٍ ثُمَّ تُفِيضِينَ عَلَيْكِ الْمَاءَ فَتَطْهُرِينَ.
উম্মে সালামাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি চুলে বেণি করে থাকি। আমি কি ফরয গোসলের সময় তা খুলে ফেলব?
তিনি বললেন, না। বরং তোমার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, তুমি মাথার ওপর তিন আজলা পানি ঢেলে দিবে। অতঃপর সারা শরীরে পানি ঢেলে পবিত্র হয়ে যাবে। —সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩৩০
অবশ্য চুলে বেণি করা না থাকলে আগা-গোড়া সব চুলেই পানি পৌঁছানো জরুরি।
মাসআলা : ওযু করার পর বাচ্চাকে দুধ পান করালে ওযু ভাঙ্গে না। কেননা দুধ পান করানো ওযু ভঙ্গের কারণ নয়।
মাসআলা : ওযু ছাড়া কুরআন মাজীদ স্পর্শ করা জায়েয নয়; বরং গোনাহ। হাদীস শরীফে পবিত্রতা ব্যতীত কুরআন মাজীদ স্পর্শ করতে সুস্পষ্টভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
সাহাবী হাকীম ইবনে হিযাম রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন—
أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمَّا بَعَثَهُ وَالِيًا إِلَى الْيَمَنِ قَالَ: لَا تَمَسَّ الْقُرْآنَ إِلَّا وَأَنْتَ طَاهِرٌ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে যখন ইয়ামানে গভর্নর হিসেবে প্রেরণ করেন তখন তাকে বলেছেন, তুমি পবিত্র অবস্থা ব্যতীত কুরআন স্পর্শ করবে না। —মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস৬০৫১
মাসআলা : মাসিকের দিনগুলোতে মহিলাদের জন্য কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করা জায়েয নয়। অবশ্য যিকির-আযকার, তাসবীহ-তাহলীল আদায় করতে পারবে। তদ্রূপ কুরআন মাজীদের যে সকল আয়াত দুআর অর্থ-সংবলিত সে সব আয়াত দুআর উদ্দেশ্যে পড়তে পারবে।
মাসআলা : শিশুকে দুধ পান করানোর সর্বোচ্চ সময়সীমা চান্দ্রবর্ষ হিসেবে দুই বছর। চান্দ্রবর্ষ হিসেবে শিশুর বয়স দুই বছর পূর্ণ হয়ে গেলে তাকে দুধ পান করানো জায়েয নয়। তাই দুই বছর পূর্ণ হওয়ার আগ থেকেই দুধ ছাড়ানোর চেষ্টা করা কর্তব্য, যেন দুই বছর অতিক্রম না করে।
মাসআলা : মহিলারা নিজ গৃহাভ্যন্তরে নামায আদায় করবে। তাদের জন্য মসজিদে গিয়ে নামায আদায় করার নির্দেশনা নেই। ঘরে নামায আদায় করাই তাদের জন্য অধিক কল্যাণকর ও পুণ্যের কাজ।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন—
صلاةُ المرأةِ في بيتها أفضلُ من صلاتها في حُجْرَتِها، وصلاتُها في مخدَعِها أفضلُ من صلاتها في بيتها.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, নারীদের জন্য ঘরের আঙ্গিনায় নামায আদায়ের চেয়ে গৃহের অভ্যন্তরে নামায আদায় করা উত্তম। আর গৃহের কোনো স্থানে নামায আদায়ের চেয়ে তার নির্জন কামরায় নামায আদায় করা অধিক উত্তম। —সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫৭০
উম্মাহাতুল মুমিনীন মসজিদে নববী সংলগ্ন ঘরে অবস্থান করা সত্তে¡ও এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পেছনে নামায পড়ার মতো সৌভাগ্যের বিষয় থাকা সত্তে¡ও তাঁরা নিজ গৃহেই নামায আদায় করতেন বলে বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত।
মাসআলা : মহিলারা পুরুষের মতো সিজদা করবে না। তারা বরং রান পেটের সাথে মিলিয়ে এবং হাত মাটিতে বিছিয়ে জড়সড়ো হয়ে সিজদা করবে।
হযরত আলী রা. বলেন—
إِذَا سَجَدَتِ الْمَرْأَةُ فَلْتَحْتَفِزْ، وَلْتُلْصِقْ فَخِذَيْهَا بِبَطْنِهَا.
মহিলা যখন সিজদা করবে সে জড়সড়ো হয়ে সিজদা করবে এবং তার উরু পেটের সাথে মিলিয়ে রাখবে। —মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, বর্ণনা ৫০৭২
বিখ্যাত তাবেয়ী ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. বলেন—
إذا سجدت المرأة فلتلزق بطنها بفخذيها، ولا ترفع عجيزتها، ولا تجافي كما يجافي الرجل.
মহিলা যখন নামায আদায় করবে সে যেন তার পেটকে উরুর সাথে মিলিয়ে রাখে এবং নিতম্ব উঁচু করে না রাখে। আর পুরুষ যেভাবে (সিজদায় অঙ্গগুলো) পৃথক রাখে সেভাবে সে যেন পৃথক না রাখে। —মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, বর্ণনা ২৭৯৮
মাসআলা : মহিলারা নামাযের ওয়াক্ত হয়ে যাওয়ার পরই নামায পড়ে নিতে পারবে। মসজিদে আযান হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা বা মসজিদের জামাত শেষ হওয়ার অপেক্ষা করার কোনো বিধান নেই।
মাসআলা : পিতা মারা গেলে পিতার সম্পত্তি থেকে ছেলে-মেয়েরা যে নিয়মে অংশ পায়, অর্থাৎ এক ছেলে দুই মেয়ের সমান সম্পত্তির অধিকারী হয় তদ্রূপ মা মারা গেলে তার সম্পত্তি থেকেও ছেলে-মেয়েরা একই নিয়মে অংশ পাবে। ‘মায়ের সম্পত্তি থেকে মেয়েরা মীরাস পায় না’ — কোনো কোনো সমাজে যে এ ধরনের প্রচলন রয়েছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও বাতিল কথা।
মাসআলা : ওযুতে চামড়ার মোজার উপর মাসাহ করা জায়েয। মহিলারাও চামড়ার মোজার উপর মাসাহ করতে পারবে। তবে কাপড়ের মোজার উপর মাসাহ করা জায়েয নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাপড়ের মোজার উপর মাসাহ করেছেন, এমন প্রমাণ নেই। চামড়ার মোজার উপর মাসাহের সময়সীমা মুকীম ব্যক্তির জন্য এক দিন এক রাত আর মুসাফিরের জন্য তিন দিন তিন রাত ।
মাসআলা : মোজার উপর মাসাহের নিয়ম হল পবিত্র অবস্থায় অর্থাৎ ওযুসহ মোজা পরবে অতঃপর যখন ওযু ভঙ্গ হয়ে যাবে তখন থেকে মোজার ওপর মাসাহ শুরু হবে।
মাসআলা : ব্যবহৃত স্বর্ণ-রুপার অলংকার যাকাতের মধ্যে হিসাবযোগ্য। তাই এগুলো অন্য স্বর্ণ-রুপা বা টাকা-পয়সার সাথে মিলে যদি যাকাতের নেসাব পরিমাণ হয়ে যায় তাহলে বছরান্তে যাকাত প্রদান করতে হবে। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে—
أن امرأةً أتت رسولَ الله صلَّى الله عليه وسلم ومعها ابنة لها، وفي يدِ ابنتها مُسْكَتان غليظَتانِ مِنْ ذهبٍ، فقال لها: أتعطين زكاة هذا؟
قالت: لا،
قال: أيَسُرُّكِ أن يسوِّرَك الله بهما يومَ القيامَةِ سوارَينِ مِن نار؟
قال: فخلعتهُما فألقَتهُما إلى النبي - صلَّى الله عليه وسلم -، وقالت: هُما لله ولرسوله.
একবার এক মহিলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এল। তার মেয়ের হাতে দুটি মোটা স্বর্ণের চুরি ছিল। তিনি তাকে বললেন, তুমি কি এর যাকাত দাও?
সে বলল, না।
তিনি বললেন, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট যে, মহান আল্লাহ এর কারণে কিয়ামতের দিন তোমাকে আগুনের দুটি কঙ্কন পরিয়ে দেবেন?
বর্ণনাকারী বলেন, সে সঙ্গে সঙ্গে তা খুলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে রেখে দিয়ে বলল, এ দুটি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য। —সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৫৬৩
মাসআলা : হাত-পায়ের নখ লম্বা রাখা ঠিক নয়। অনেকেরই নখ লম্বা রাখার প্রবণতা রয়েছে, যা কাম্য নয়। বরং প্রিয় নবীজীর শিক্ষা হল নখ খাটো রাখা। তাই প্রতি সপ্তাহেই নখ কেটে নেয়া উচিত। আর চল্লিশ দিন অতিক্রম করা তো গোনাহ। শিশুদের ক্ষেত্রেও বিষয়টির প্রতি লক্ষ রাখা পিতা-মাতার কর্তব্য।
মাসআলা : নেইল পলিশের নিচে পানি পৌঁছে না। তাই নখে পলিশ থাকা অবস্থায় ওযু করলে নখে পানি না পৌঁছার কারণে ওযু হবে না। সুতরাং ওযুর আগে রিমুভার বা অন্য কিছু দিয়ে পলিশ পরিপূর্ণরূপে উঠিয়ে ওযু করতে হবে।
মাসআলা : শরীরে উল্কি আঁকা জায়েয নয়; বরং তা কবীরা গোনাহ। হাদীস শরীফে উল্কি অঙ্কনকারীর উপর অভিসম্পাত এসেছে।
সহীহ বুখারীতে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন—
أَنَّ النَّبِيَّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَعَنَ الوَاشِمَاتِوَالمُسْتَوْشِمَاتِ وَالمُتَنَمِّصَاتِ مُبْتَغِيَاتٍ لِلْحُسْنِ مُغَيِّرَاتٍ خَلْقَ اللَّهِ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিসম্পাত করেছেন এমন নারীর উপর, যারা শরীরে উল্কি আঁকে এবং অন্যকে দিয়ে উল্কি আঁকায় এবং সৌন্দর্যের জন্য ভ্রæর চুল উপড়ে ফেলে আল্লাহর সৃষ্টিকে পরিবর্তন করে। —জামে তিরমিযী, হাদীস ২৭৮২
সুতরাং মুমিন নর-নারীদের এ ধরনের লা‘নতের কাজ থেকে বিরত থাকা জরুরি।
মাসআলা : চাচা শ্বশুর, মামা শ্বশুর, খালু শ্বশুর, দেবর মাহরাম নয়। তাদের সঙ্গে পর্দা রক্ষা করা জরুরি।