সাক্ষাৎকার
‘সন্তানের আদর্শ তারবিয়তের জন্য মায়েরই সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হয়’
[উম্মে আবদুল্লাহ। বয়স ও জীবনের অভিজ্ঞতায় প্রবীণএক মহীয়সী নারী। আমল, আখলাক, পরপোকার ও বিদ্যোৎসাহে এক অনন্য মানুষ। তিনি মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ও মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেবদের শ্রদ্ধেয় মা। আত্মীয়তার সম্পর্কে তিনি আমার দাদি শাশুড়ি। সাক্ষাতের প্রথম দিন থেকেই তাঁর আমল ও আখলাকে মুগ্ধ হয়েছি। সেই মুগ্ধতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই পাচ্ছে। তার সান্নিধ্যের প্রতিটি মুহূর্তই অন্তরকে তুলার মতো নরম করেছে। আমলের স্পৃহা নতুন করে জাগ্রত করেছে। সেটা ভিন্ন কথা— কতটুকু কাজে লাগাতে পেরেছি আর কতটুকু অনাদর-অবহেলায় নষ্ট করেছি। তবুও মাঝে মাঝে নিজের সৌভাগ্যে অবাক হয়েছি, আমি এমন একজন মানুষের পায়ের কাছে বসতে পেরেছি। ক’দিন ধরে তাঁর নাতি আব্দুর রকীব ভাইকে বলছিলাম, দাদিজানের একটা সাক্ষাৎকার নেব। প্রশ্ন প্রস্তুত করুন। তিনি আমার ডাকে সাড়া দিয়েছেন। প্রাণবন্ত একটি সাক্ষাৎকার নিয়ে দিয়েছেন। অন্য সব সময়ের মতো আজও হৃদয় অশ্রু সজল হয়েছে। দুনিয়াবী ব্যস্ততায় শক্ত হতে থাকা অন্তর নরম হয়েছে। সাক্ষাৎকার চলাকালে চোখের কোণে জমে ওঠা অশ্রু লুকিয়েছি হাসি ও নীরবতার আড়ালে। তার সেই হৃদয় নিংড়ানো কথা হুবহু কাগজের পাতায় তুলে আনা অনেক কঠিন। তবুও আমরা চেষ্টা করেছি। পাঠক শুধু সেই চেষ্টার দিকে তাকিয়ে হৃদয়ের কথা হৃদয়ের উপযুক্ত করে তুলে আনতে না পারার ব্যর্থতা ক্ষমা করবেন। আল্লাহ পাক এই মহীয়সীকে হায়াতে তায়্যিবা নসীব করুন। তাঁর মতো আমলের স্পৃহা আমাদেরও দান করুন আমীন।—ওয়ালিউল্লাহ আব্দুল জলীল]
আবদুর রকীব : আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ।
উম্মে আবদুল্লাহ : ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ।
আবদুর রকীব : নানুজান কেমন আছেন?
উম্মে আবদুল্লাহ : আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন।
আবদুর রকীব : ইনশাআল্লাহ আগামী মার্চ ২০২২ ঈসাব্দে মাসিক আলকাউসারের নারী পত্রিকা আসছে। আমরা আপনার কাছথেকে দুআ নিতে এসেছি। দুআ চাই, আল্লাহ যেন পত্রিকাটিকে কবুল করেন।
উম্মে আবদুল্লাহ : আল্লাহ কবুল করুন।
আবদুর রকীব : ইতিপূর্বে আপনার আংশিক আত্মজীবনী ফরিদাবাদ মাদরাসা থেকে প্রকাশিত মাসিক নেয়ামতে প্রকাশিত হয়েছে। সেই থেকে অনেকেই আপনার জীবন-সংগ্রাম ও সন্তানদের গড়ে তোলার জন্য নিরবচ্ছিন্ন সাধনা সম্পর্কে জানতে ইচ্ছুক। মানুষের আগ্রহকে সম্মান জানাতে আজকের এই সাক্ষাৎকারের আয়োজন। আপনি যদি পাঠকদের জন্য আপনার শৈশবের স্মৃতিচারণা করতেন।
উম্মে আবদুল্লাহ : শৈশবের কথা কী বলব। কত আগের কথা। আমার ছয় বছর বয়সে মা অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হন। ভাই-বোনেরা সবাই ছোট ছোট। আমার ছোট্ট কাঁধেই পড়ে ঘর সামলানোর দায়িত্ব। মায়ের সেবা-যত্ন, ছোট ভাই-বোনের দেখাশোনা করতে হত আমাকে। এসব কারণে তখনো আমার লেখা-পড়া শুরু হয়নি। ভাইয়েরা পাঠশালায় পড়তে যেত। আমি থাকতাম ঘর সামলানোর কাজে ব্যস্ত। একদিন বাবাকে বললাম, আমাকে পড়াবেন না? আমার খুব পড়তে ইচ্ছে করে।
বাবা তখন বাইরে থেকে একটি কলাপাতা ছিঁড়ে আনলেন। সে পাতায় আলিফ বা তা লিখে দিলেন। আমি বললাম, বাংলা লিখে দেবেন না?
বাবা তখন আরেকটি কলাপাতায় বাংলা অক্ষর লিখে দিলেন। এরপর কয়েকবার আমাকে পড়িয়ে দেন। শেষে আমাকে শোনাতে বললেন। আমি পুরোটাই শুনিয়ে দিই। বাবা খুশি হন, অনেক দুআ দেন। বলেন, ‘তুমি তো বেশ ভালো পেরেছ। তোমার আম্মা সুস্থ হলে তুমি পড়াশোনা করবে।’ আমাদের ঘরে তখন কাগজ-কলম ছিল না। সেকালে যেসব বই বাদ হয়ে যেত সেসব বইয়ের পাতা দিয়ে বাজারে সদাই বেঁধে দিত। সদাইয়ের মোড়ক হয়ে আসা পরিত্যক্ত বইয়ের পাতাগুলোও আমার পড়াশোনার মাধ্যম ছিল। সেগুলো পড়ে পড়ে হরফ চিনেছি, পড়া শিখেছি। একদিন বাবা গুড় এনেছিলেন। গুড়ের সঙ্গে আসা ঠোঙ্গার দুয়েকটি লেখা এখনো মনে পড়ে। সে পাতাটিতে লেখা ছিল, دعني أذهب আমাকে যাইতে দাও। دق الجرس الآن এখন ঘণ্টা বাজাও।
মায়ের আর সুস্থতা নসীব হয়নি। এই শয্যাশায়ী অবস্থায়ও কয়েকজন সন্তান জন্ম নেয়। যার দরুন আমারও কাজ বাড়তে থাকে। সেইসঙ্গে বাড়তে থাকে পড়ার প্রতিও তীব্র আকর্ষণ। বাবার কাছে পড়ার জন্য বায়না ধরি। বাবা নিজের ব্যস্ততা ও মায়ের অসুস্থতার কথা বলে এড়িয়ে যান। নানার বাড়ি ছিল কাছেই। বিল অতিক্রম করে খালের ওপার। নানাবাড়িতে অনেক কিতাব ছিল। আমি নানাবাড়িতে কিতাবের আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম। মামা বলতেন, তুমি কিতাবের আলমারির সামনে কী কর? কিতাব ধরবে না, নষ্ট হয়ে যাবে। তবুও আমার কিতাবের আলমারির দিকে তাকিয়ে থাকার নেশা কাটত না। মামার অবর্তমানে আলমারি থেকে আমার পড়ার মতো কিতাব লুকিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসতাম। পড়া শেষে সবার অগোচরে আবার রেখে আসতাম। এভাবে কিছু পড়তে শিখে যাই।
আবদুর রকীব : নানুজান আপনার যখন আপনার বাবার কথা মনে পড়ে তখন কোন কথাটা প্রথমে মনে পড়ে?
উম্মে আবদুল্লাহ : বাবা খুব দান করতেন। ঘরে কিছুই নেই। এ অবস্থায় পকেটে এক টাকা থাকলেও ভিক্ষুককে দিয়ে দিতেন। কিছুই রাখতেন না।
আবদুর রকীব : আপনি তো আল্লাহর মেহেরবানীতে কুরআন মাজীদ হিফয করেছেন, সেটা কীভাবে করেছেন একটু বলবেন?
উম্মে আবদুল্লাহ : আমার বয়স তখন আট বছর।একদিন নানাবাড়ি গেলাম। নানু আমাকে বললেন, মুশতারী তো সূরা কাহফ মুখস্থ করে ফেলেছে। তুমি কি কুরআন শরীফ কিছু মুখস্থ করেছ?
মুশতারী ছিল আমার মামাতো বোন। বয়সে আমার দুই বছরের বড়। আমি বললাম, জী না নানুজান, আমি কিছু পড়ি না। আব্বাজান বলেছেন, আম্মার অসুখ ভালো হলে পড়াবেন।
নানু বললেন, কী বলো, বড় হয়েছ এখনো পড়ো না। তুমিও একটু একটু পড়তে থাকো। নিজে নিজে শুরু করে দাও।
বাসায় এসে বাবাকে নানু যা যা বলেছেন সব বললাম। বাবা বললেন, পড় নাÑ একথা তোমার নানুকে বলতে গেলে কেন? আমি না সেদিন তোমাকে কলা পাতায় লিখে দিলাম!
বললাম, শুধু লিখেই তো দিয়েছেন। পড়ান তো আর না।
এরপর বাবাকে জোর করে কায়েদা পড়াতে রাজি করলাম। তখন লম্বা সাইজের কায়েদা বোগদাদী ছিল। বাবা কায়েদায়ে বোগদাদির آناكم، بانكم، أنكم، بأنكم পর্যন্ত পড়ালেন। এরপর বাবা আর পড়াতে পারেননি। এটুকু পড়ার পর আমার অনুমান হয়ে গেল, কুরআনে কারীমে কী আছে। একদিন নানা বাড়ি থেকে লুকিয়ে একটা আলিফ লাম মিম নিয়ে আসি। ঘরে বসে একা একা পড়া শুরু করি। মনে হল, পড়া হচ্ছে।
একদিন বাবাকে বললাম, আমার কুরআন পড়াটুকু একটু শুনুন না।
বাবা বললেন, কুরআন এভাবে পড়া যায় না।
আমি বললাম, একটু শুনেই দেখুন।
বাবাকে কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে শোনালাম। বাবা বললেন, মাশাআল্লাহ হচ্ছে তো। এরপর থেকে মুখস্থ শুরু করলাম। পাশে কুরআন কারীম রেখে কাজ করতাম। কুরআন মুখস্থ করতে থাকতাম আর কাজ করতাম। চুলায় জ্বাল দিতে দিতে পড়তাম। তরকারি কুটতে কুটতে পড়তাম। মাছ কাটতে কাটতে পড়তাম। এভাবে পড়তে পড়তে একদিন পূর্ণ কুরআন মুখস্থ হয়ে যায়।
আবদুর রকীব : কত বছর লেগেছিল হিফয করতে?
উম্মে আবদুল্লাহ : কত বছর লেগেছিল সেটা তো মনে নেই।
আবদুর রকীব : একটা কথা প্রচলিত আছে, মেয়েদের হিফয করা ঠিক না। মেয়েদের কুরআন ইয়াদ থাকে না। এ ব্যাপারে কী বলেন?
উম্মে আবদুল্লাহ : মহিলাদের হিফয ইয়াদ থাকে না— কথাটা ঠিক না। নিয়মিত পড়লে অবশ্যই ইয়াদ থাকে। আমার অনেক নাতনি আল্লাহর রহমতে হিফজ করেছে এবং আল্লাহর রহমতে সবারই তো ইয়াদ আছে। সবাই এখন মাদরাসায় পড়ায়। আল্লাহ পাকের রহমত আল্লাহ পাক করেছেন। হাঁ, বিশেষ সময়গুলোতে পড়তে না পারলে পড়া কিছুটা কাঁচা হয়ে যায়। তিলাওয়াত করলে আল্লাহর রহমতে ঠিক হয়ে যায়। আমার তো নয় সন্তান হয়েছিল। নয় বারই আমার ইয়াদ কাঁচা হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে তিলাওয়াত করতে করতে খুব সহজেই ইয়াদ পাক্কা হয়ে যায়। মেয়েরা বিশেষ মাযুরীর কারণে যদি ভুলেও যায়, ইনশাআল্লাহ সেটা বেবরকতির কারণ হবে না।
আবদুর রকীব : আপনার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে কিছু বলুন।
উম্মে আবদুল্লাহ : তাদেরকে লেখা-পড়া করাতে বেশ কষ্ট হয়েছে। বড় ছেলে পাঁচ বছর বয়সেই সকাল-সন্ধ্যার দুআ, নামাযের যাবতীয় দুআ, তাসবীহ-তাহলীল শুনে শুনে শিখে নেয়। ছয় বছর শেষে সাত বছর শুরু হলে একদিন কায়েদা পড়িয়ে দিই। এক দিনেই কায়েদা অনেকাংশ পড়ে ফেলে। আল্লাহর রহমতে মেধা ভালো ছিল। আগের দিন কায়েদা পড়িয়েছি। পরের দিন কুরআন মাজীদ সামনে নিয়ে নিজে নিজে পড়া শুরু করেছিল।
আমি কয়েকবার বলে দেয়ার পর সহজে পড়তে শুরু করে। প্রতিদিন ছয় পৃষ্ঠা করে পড়তে বলি। ছয় পৃষ্ঠা শেষ করে আমার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে উঠত। এভাবে আমার কাছে কিছু অংশ মুখস্থ করে ফেলে। তখন এত হিফযখানা ছিল না। এজন্য বড় দুই ছেলেকে হিফযখানায় পড়াতে পারিনি। তাই তাদের নিয়মতান্ত্রিক হিফয করা হয়নি। এরপর মাদরাসায় চলে যায়। অন্য ছেলেদেরকে হিফযখানায়ই পড়তে দিই। আর আমার মেয়ে আমার কাছেই হিফয থেকে শুরু করে যাবতীয় পড়াশোনা করে।
আবদুর রকীব : ছেলেমেয়েদের তরবিয়তের ক্ষেত্রে কী কী বিষয় খেয়াল করেছেন?
উম্মে আবদুল্লাহ : ভাই, আল্লাহ পাকের রহমত, আল্লাহ পাক করেন। কিন্তু সন্তানের আদর্শ তরবিয়তের জন্য মায়েরই সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। নিজে এমন কাজ করতে হয়, যেগুলো দেখে ছেলেমেয়েরা মুগ্ধ হয়। তরবিয়তের আদর্শ পদ্ধতি হল, নিজে ভালো কাজ করা, সন্তানদেরকে দিয়ে ভালো কাজ করানো। সন্তানরা দেখতে থাকবে আর বুঝতে থাকবে, এগুলো করতে হয়। তখন বাচ্চাদের অন্তরে এ ভালো কাজটা গেঁথে যাবে। একসময় তাদের অভ্যাসে পরিণত হবে। আর বাচ্চা গর্ভে আসতেই শুরু করতে হবে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি। বেশি বেশি তিলাওয়াত, বেশি বেশি নামায, নামাযের মধ্যে বেশি বেশি আল্লাহর কাছে চাইতে হবে, আল্লাহ পাক যেন আল্লাহ পাকের মুন্তাখাব বান্দা বানান। সন্তান জন্মের পর থেকে আজীবন সন্তানের জন্য এ দুআ অব্যাহত রাখবে। আল্লাহ পাক যেন ইলমে নাফে‘ ও আমলে সালেহ নসীব করেন। আল্লাহ পাক যেন তাঁর মুন্তাখাব বান্দা/বান্দী বানান।
আবদুর রকীব : মাশাআল্লাহ, আপনার ছেলেমেয়েরা তো আপনার দুআ ও চাওয়া অনুযায়ী সফল মানুষ। ছেলেমেয়েদের সফল হতে দেখে আপনার অনুভূতি কী?
উম্মে আবদুল্লাহ : আল্লাহ পাকের রহমত, আল্লাহ পাক করেছেন। আমার অনুভূতি আর কী হবে—
دادِ او را قابلیَّت شَرط نیست + بلکہ شَرطِ قابلیَّت دادِ اوست
তাঁর অনুগ্রহ লাভের জন্য যোগ্যতা শর্ত নয়/যোগ্যতার জন্য শর্ত হল তাঁর অনুগ্রহ লাভ।
আবদুর রকীব : ছেলেমেয়েদের মধ্যে কার প্রতি বেশি টান অনুভব করেন। অথবা ছেলেমেয়েদের মধ্যে কে বেশি আপনার প্রতি টান অনুভব করেন?
উম্মে আবদুল্লাহ : সবার প্রতিই তো আমি সমান টান অনুভব করি। ছেলেমেয়েদেরও কারো চেয়ে কারো কম টান নয় আমার প্রতি। একেকজনের একেক আন্দাজ। বড় ছেলে একবার আমাকে লিখে পাঠিয়েছিল—
میری اما میری مادر اے میری جان جگر + آپ کی يادوں کے ہردم ہے میرے دل میں اثر
ایک لمحہ کیلئے بھی ہو نہیں سکتی جدا + قلب کی گہرائیوں میں آپ رہتی ہیں سدا
আমার আম্মা, আমার জননী, আমার কলিজা,/আপনার স্মৃতি হরদম আমার দিলে তাজা।
মুহূর্তের জন্যও আমি যেতে পারি না দূরে/হৃদয়ের গভীরে সদা আপনার বসবাস।
আবদুর রকীব : আপনার সময় এখন কীভাবে কাটে?
উম্মে আবদুল্লাহ : আল্লাহ পাক মেহেরবানী করেন। মানুষের কাছে বসে থাকি। ভোর থেকেই আমার মতো বুড়ি বুড়ি মানুষেরা আসে। ওদের কাছে থাকি। আল্লাহ পাক রহম করেন, এক হরফ দু-হরফ বলে দিই। ওরা পড়ে, আমি কাছে থাকি। আমি তো লেখা-পড়া পারি না। পৌনে বারোটা পর্যন্ত বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে ছাত্রীরা আসে যায়। আপু (বড় ছেলের মেয়ে) আর আম্মাজান (মেঝ ছেলের স্ত্রী) নয়টা থেকে দশটা পর্যন্ত এক ঘণ্টা আমাকে সাহায্য করেন। ছুটির পর তাড়াহুড়া করে এসে যোহরের নামাযের জন্য দাঁড়াই। এরপর তিলাওয়াত করি। কাপড় সেলাই করি। ঘর মুছি। কাপড় ধুই।
আবদুর রকীব : আপনার এই কাজগুলো চাইলেই তো অন্যরা করে দেন। আপনি এত কষ্ট করেন কেন?
উম্মে আবদুল্লাহ : হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের কাজ নিজে করতেন। আবার অন্যের কাজও কিছু কিছু করে দিতেন। স্ত্রীদের কাজেও তিনি সহযোগিতা করতেন। সেজন্য আমি আল্লাহর কাছে দুআ করি—
دائماں دائم نظام اوقات کی توفیق دیں
پابند رکھیں ہم کو اپنے فضل سے دائماں دائم
اپنے نظام اوقات کے پابند رکھیں اپنے فضل سے
وقت کے کل کام ہم کو وقت پر کرنے کی توفیق دیں
وقت میں برکت ہمارے بے بہا دیں بے انتہاء دیں
এ দুআ পড়তে থাকি আর কাজ করতে থাকি। কখন কাজ শেষ হয়ে যায় আমি টেরই পাই না। আসরের পর কিছু তাসবীহ পড়ি।
আবদুর রকীব : তাসবীহের পরিমাণ কতটুকু?
উম্মে আবদুল্লাহ : আল্লাহ পাক যতটুকু তাওফীক দেন। এর মধ্যে আপনি আসেন। কিছু তিলাওয়াত শোনেন। কখনো দু-তিন জন এলে আর তিলাওয়াত শোনানো হয় না।
আবদুর রকীব : আপনার কুরআন মাজীদ তিলাওয়াতের তারতীব কী? কত খতম হয়?
উম্মে আবদুল্লাহ : ফরয সুন্নত নফল মিলে নামাযে একটি খতম হয়ে থাকে। একটি খতম ছাত্রীরা শোনে। আরেকটি খতম আমি নিজে যেটা তিলাওয়াত করি। কাজে-কর্মে হাঁটা-চলায় একটি খতম করা হয়। আপনি (আবদুর রকীব) যেটা শোনেন সেটা ভিন্ন একটা খতম।
আবদুর রকীব : প্রতিদিন নামাযে কতটুকু তিলাওয়াত হয়?
উম্মে আবদুল্লাহ : কোনো দিন পাঁচ পারা, কোনো দিন ছয় পারা হয়।
আবদুর রকীব : একসময় তো আপনার প্রতি তিন দিনে এক খতম হত?
উম্মে আবদুল্লাহ : জী। এখন যে ভিন্ন ভিন্ন খতম হয় তাই সময় কমে যায়। আবার পড়ানোতেও অনেক সময় চলে যায়।
আবদুর রকীব : আপনার মাদরাসায় কোন্ পদ্ধতিতে পাঠদান করেন?
উম্মে আবদুল্লাহ : আমি মূর্খ মানুষ। আমি কি নিয়ম-কানুন জানি? সেগুলো শুনলে আপনারা হাসবেন। প্রথমে কিছু দুআ পড়ি। এরপরে নামাযের ভেতরে যা পড়া হয় সেগুলো প্রতিদিনই মুখে মুখে শিখাই। এর ভেতর থেকেই অনেকে পড়া শুদ্ধ করে কায়েদা নেয়। কায়েদা শেষ করে কুরআন মাজীদ নেয়। এখন সম্ভবত কুরাআন মাজীদ পড়ে পঞ্চাশ জনেরও বেশি। এক গ্রুপ আমার কাছে কুরআন মাজীদ পড়ে। আপুর কাছে আরেক গ্রুপ কুরআন মাজীদ পড়ে।
আবদুর রকীব : মাসআলা-মাসায়েল কীভাবে পড়ান?
উম্মে আবদুল্লাহ : সকাল থেকেই তো ছাত্রীরা পড়তে আসা শুরু করে। অনেকে পড়া শেষ করে চলে যায়। যারা দশটা পর্যন্ত থাকে তাদেরকে কিতাব থেকে মাসআলা পড়ে শুনাই। এই ক’দিন ধরে তুহফাতুল মুসলিমাহ পড়ছি। এর আগে পড়েছি ফিকহুন নিসা। তারও আগে পড়েছি বেহেশতী জেওর।
আবদুর রকীব : আপনার এখানে সাপ্তাহিক তালীম কবে হয়?
উম্মে আবদুল্লাহ : বৃহস্পতিবার নয়টা থেকে দশটা পর্যন্ত তালীমের সময়। কিন্তু সাতটা থেকে এগারোটা পর্যন্তই মানুষজন থাকে।
আবদুর রকীব : নানু, আপনার ছেলেমেয়ে নাতিনাতকর সবাই আপনার খেদমত করতে চায়। কাউকে সুযোগ না দিয়ে আপনি একা থাকেন কেন?
উম্মে আবদুল্লাহ : ভাইয়াজান, কাউকে যে কষ্ট দিতে মনে চায় না। সবাই তো চায়। কিন্তু আমি গেলে তো আমার জন্য আলাদা কষ্ট করতে হবে। এজন্য দুআ করবেন, আল্লাহ পাকের ডাক আসা পর্যন্ত আমি যেন নিজের কাজ নিজে করে যেতে পারি। আমার পাশে একজন আম্মাজান আছেন। তিনি আমার সব করে দিতে চান। কিন্তু আমি দিই না। কাছে যারা নেই, তাদের কাছে আমি গেলে তো আমাকে আদরেই রাখে। আমি তো যাই না।
আবদুর রকীব : আপনি আমল ও মুজাহাদার এ পর্যায়ে কীভাবে পৌঁছেছেন?
উম্মে আবদুল্লাহ : আপনি কী আমল দেখেছেন আমার! আমি তো পাপী। আমার পাপে ভরা জীবন। আপনি আমার পর্যায় কোথায় পেয়েছেন? কিছু বলতে কিছুই নাই। শুধু সকলের সাথে মিলেমিশে থাকি; যদি আল্লাহ পাক দয়া করেন, আমাকে কিছু দেন। তিনি যেন তাঁর খুশিমতো আমাকে ডাকেন। বেশি বেশি এ দুআ পড়ি—
إلهي نَجِّنِي مِن كُل ضِيقٍ + بجاه المصطفى مولى الجميع
وهب لي في مدينة الرسول قرارًا + بإيمان ودفنٍ بالبقيع
হে প্রভু, তুমি আমাকে সব সংকট থেকে মুক্তি দাও
মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম এর ওসিলায়।
তুমি আমাকে রাসূলের শহরে বাসস্থান দাও
ঈমান ও জান্নাতুল বাকীতে দাফনের মাধ্যমে।
আবদুর রকীব : নানুজান, আপনার অনেক সময় নিয়ে নিয়েছি। শেষ একটি প্রশ্ন, আপনি যে ফরযগুলো গুরুত্বের সাথে আদায় করেন, সাথে সাথে নিয়মিত সকল প্রকার নফল পড়েনÑ এটা আপনি কীভাবে অর্জন করেছেন?
উম্মে আবদুল্লাহ : একদিন রান্না করতে করতে কিয়ামতের আলামত নামে একটি বই পড়ছিলাম। পড়তে পড়তে সামনে এল সূরা ইয়াসীনের এই আয়াতটি—
اَلْیَوْمَ نَخْتِمُ عَلٰۤی اَفْوَاهِهِمْ وَ تُکَلِّمُنَاۤ اَیْدِیْهِمْ وَ تَشْهَدُ اَرْجُلُهُمْ بِمَا کَانُوْا یَكْسِبُوْنَ.
আজ আমি তাদের মুখে মোহর লাগিয়ে দেব। ফলে তাদের হাত আমার সাথে কথা বলবে এবং তাদের পা সাক্ষ্য দেবে তাদের কৃতকর্মের। —সূরা ইয়াসীন (৩৬) : ৬৫
আয়াতের তরজমার দিকেও নযর যায়নি। এর মধ্যে আমার দেহে কম্পন শুরু হয়ে গেল। দ্রæত পুকুরে গিয়ে গোসল করে আসি। এসে রান্না ঘরেই নামাযে দাঁড়িয়ে যাই। তখন আমার নামায পড়ারও বয়স হয়নি। সেই যে হৃদয়ে এক কম্পন শুরু হল সে কম্পন আর থামেনি। মনে হয়েছে, বেশি বেশি নামায পড়লে, বেশি বেশি রোযা রাখলে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের ভয়াবহতা থেকে মুক্তি দেবেন। সেদিন থেকে আর নামায ছাড়তে পারিনি।
আবদুর রকীব : মূল্যবান সময় দিয়ে আপনি আমাদেরকে ধন্য করেছেন।আল্লাহ তাআলা আপনাকে জাযায়ে খায়ের দান করুন। সিহহাত ও আফিয়াতের সঙ্গে আল্লাহ আপনাকে হায়াতে তায়্যিবা তাবিলা নসীব করুন।
উম্মে আবদুল্লাহ : আল্লাহ আপনাকেও জাযায়ে খায়ের দান করুন।