জুমাদাল আখিরাহ ১৪৪৩   ||   ফেব্রুয়ারি -এপ্রিল ২০২২

পর্দা করব বলে

উম্মে তাশফিয়া

বাংলাদেশ একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। অথচ এখানে কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের পর্দা করে চলা বেশ কঠিন। অথচ পর্দা করা একজন মেয়ের উপর মহান আল্লাহর ফরয হুকুম। একজন কর্মজীবী মেয়ে হিসেবে আমাকেও কিছু বাধা পেরিয়ে আসতে হয়েছে। এক্ষেত্রে মূল সমস্যা দ্বীন সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা।

মুসলিম হয়েও এমন একটা সামাজিক ও পারিবারিক পরিমণ্ডলে আমরা বেড়ে উঠি, যেখানে আমাদের শিক্ষাজীবন শুরু হয় কেবল দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। তাই শিক্ষাজীবন শেষে অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটি নামকরা স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করি। পর্দা করা ভালো জানলেও পর্দা যে আমার জন্য ফরয জানতাম না। কর্মজীবন শুরুর বেশ কিছুদিন পর সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর কিছু দ্বীনী বই পড়ে এবং আমার এক ভাইয়ের অনুপ্রেরণায় পর্দা শুরু করলাম। কিন্তু আমার কর্মক্ষেত্রে পর্দা করে চলা কঠিন ছিল। সেখানে মেয়েদের জন্য নির্ধারিত রং-এর শাড়ি পরার নিয়ম ছিল।

যাই হোক, বোরকা পরে একদিন উপস্থিত হলাম স্কুলে। নানাজনের নানা রকম মন্তব্য শুনলাম। একজনের মন্তব্য, আপনি কি আয়নায় নিজেকে দেখেছেন কেমন লাগছে আপনাকে?

একজন বললেন, দেখে মনে হয় পেটিকোট পরে এসেছে।

নানা রকম মন্তব্যের মাঝে কিছু মানুষ সাধুবাদ জানাতে চাইলেও মুখ ফুটে বলতে পারেননি। নীরব সমর্থন জানিয়েছে। কিছুদিন পর কয়েকজন আমাকে অনুসরণ করে পর্দা করা শুরু করলেন। তখন পরিস্থিতি কঠিন হয়ে উঠল। একদিন অধ্যক্ষ মহোদয় আমাকে ডেকে লিখিত দিতে বললেন পর্দা ও হিজাব কী? লিখে দিলাম। প্রায়ই আমাকে বলা হত, এই রং-এর বোরকা পরতে পারবেন না; যদিও তাদের দেয়া রং-এর বোরকা পরতাম। স্কুলে আসার পর পাঠিয়ে দিত স্কার্ফ বদলে আসার জন্য।

এভাবেই নানা রকম ঝামেলার মধ্যে দিন যাচ্ছিল। নতুন ভাইস প্রিন্সিপাল এসে প্রায়ই বলতেন আমার পোশাক ঠিক নেই; অর্থাৎ শাড়ি পরছি না কেন? বিভিন্নভাবে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। সিদ্ধান্ত নিলাম, শাড়ি পরব না। চাকরি গেলে যাবে।

একদিন নোটিশ পাঠানো হল, সামনের মাসের ১ তারিখ থেকে সবাইকে শাড়ি পরে আসতে হবে। নইলে চাকরি চলে যাবে। সেদিন আমি ছাড়া সবাই শাড়ি পরে এসেছিলেন। খবর চলে গেল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির কাছে। তিনি সরেজমিনে দেখার জন্য স্কুলে এলেন। দূর থেকে আমাকে দেখে তাঁর মন্তব্য ছিল, উনি তো খুব মার্জিত পোশাক পরেছেন।

শিক্ষক প্রতিনিধির মাধ্যমে আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি কী পোশাক পরতে চাই।

আমি জানালাম, বোরকা পরে আসতে চাই।

তখনই স্কুল কর্তৃপক্ষ রেজুলেশন পাশ করলেন, যারা চায় বোরকা পরে আসতে পারবে।

সেই থেকে আবার অনেকে বোরকা পরা শুরু করলেন। তবে সমস্যা শেষ হল না।

২০১২ সাল। পরম করুণাময় আল্লাহর অসীম দয়ায় হজ্ব পালনের সৌভাগ্য হল। হজ্বের পর থেকে নেকাব পরা শুরু করলাম। হজ্বের পর যেদিন প্রথম স্কুলে গেলাম, অধ্যক্ষ আমাকে ডেকে বললেন, আপনি কি এভাবেই আসবেন?

আমি হাঁ সূচক উত্তর দিয়েছিলাম।

এরপরও সমস্যা থামেনি। ছাত্র-ছাত্রীদের ধর্মীয় কথা বলা যেত না। এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ছাত্রীকে নিকাব খুলতে বাধ্য করা হলে প্রতিবাদ করেছি। স্কুলে কোনো ছাত্রী পর্দা করতে চাইলে বাধা আসত। আমি তাদের পক্ষ নিতাম। ফলে আমিও সমস্যার সম্মুখীন হতাম।

এমন বিরূপ পরিবেশে থাকতে মন সায় দিচ্ছিল না। একদিন চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে এলাম। মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানালাম।

 

 

advertisement