জুমাদাল আখিরাহ ১৪৪৩   ||   ফেব্রুয়ারি -এপ্রিল ২০২২

দ্বীনী পরামর্শ

জীবন চলার পথে দ্বীনের ওপর চলতে আপনি কোনো জটিলতার সম্মুখীন হলে পরামর্শের জন্যে লিখে পাঠাতে পারেন এই ইমেইলে, nari@alkawsar.com।  জবাব দিচ্ছেন, মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ ছাহেব।

১. প্রশ্ন : আমি একজন ভালো মুসলিম মেয়ে হতে চাই। দ্বীন-শরীয়ত সম্পর্কে জানতে চাই। কিন্তু পরিবারের চাপে পড়ে পর্দা করতে পারছি না। আমি তাদের বোঝাতে চেষ্টা করি, কিন্তু তারা এ ব্যাপারে একদমই আগ্রহ বোধ করে না। মাঝে মাঝে মা জোর করে মাজারে নিয়ে যান, বাবা-ফকিরদের নিকট হাত জোড় করতে বলেন, আরো নানান ধরনের শিরকী কর্মকাণ্ড আমাকে জোর করে করান। একজন মেয়ে মানুষ আমি, প্রতিকূল পরিবেশে ঈমানের দাবি পূরণ করতে পারছি না। আমার করণীয় কী? পরিবারের সঙ্গে আমার আচরণ কেমন হবে?

উত্তর : আপনি একজন ভালো মুসলিম মেয়ে হতে চান, এটি খুশির বিষয়। একজন মুমিনের জন্য প্রথম কাজ এটিই; তাকে ইসলামের ওপর চলার জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হতে হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে সকাল-সন্ধ্যায় যে সকল দুআ পড়তে শিখিয়েছেন সেগুলোর একটি হল, সায়্যিদুল ইস্তিগফার।

হাদীসে দুআটি অন্তরের দৃঢ় বিশ্বাস থেকে পড়তে বলা হয়েছে। এর মানে হল, আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দী এবং বান্দাদের কাছে তাঁর এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেয়া বিধি-বিধান মেনে চলার সংকল্প বারবার উচ্চারিত করাতে চান। আল্লাহ তাআলা আপনার জন্য দ্বীনের উপর চলা সহজ করে দিন।

আপনি লিখেছেন, আপনি পর্দা করতে চান, কিন্তু পরিবারের চাপে পারছেন না। আপনি নিজ ইচ্ছার ওপর অটল থাকুন। পর্দা করা শুরু করে দিন। এরপর যদি আল্লাহ না করুন অভিভাবকদের কেউ আপনাকে যথাযথ পর্দা না করতে দেয় তাহলে এর জন্য তাঁরাই দায়ী হবেন। আপনি দায়ী হবেন না।

তবে অভিভাবকদেরকে শান্তভাবে ইসলামের বিধান এবং এর সৌন্দর্য বোঝাতে চেষ্টা করবেন। এবং সাধারণ অবস্থায় মা-বাবা ও পরিবারের লোকদের সাথে সদাচরণ করবেন। তাদের ভালো কথায় অবাধ্য হবেন না। আর শরীয়তবিরোধী পীর-ফকীরদের কাছে আপনাকে নিয়ে যেতে চাইলে আপনি কোনো ওজর পেশ করে না যাওয়ার চেষ্টা করবেন। এরপরও কখনো একান্ত বাধ্য হয়ে যেতে হলে সেখানে গিয়ে শিরকী কাজ থেকে বিরত থাকবেন। কোনো শিরকী বাক্য মুখে উচ্চারণ করবেন না। মনে মনে মাসনূন দুআ পড়বেন। আরেকটি কথা, ইতিবাচক পরিবেশে দ্বীনের ওপর চলা যতটুকু সওয়াব প্রতিকূল পরিবেশে দ্বীন মেনে চলার সওয়াব এর চেয়ে বেশি। আশা করি, আপনার জটিলতাগুলো ধীরে ধীরে কেটে যাবে ইনশাআল্লাহ।

২. প্রশ্ন : আল্লাহর রহমতে এখন যতটুকু পারি চেষ্টা করি ইসলামের বিধি-বিধান মেনে চলতে। আগের কৃত ভুলের কারণে আল্লাহর কাছে বারবার মাফ চাই। আমি বিশ্বাস করি, আল্লাহ ক্ষমাশীল। কিন্তু আশপাশের মামি-চাচিরা খোঁচা মেরে বলেন, তোদের মতো মেয়েরাই পর্দা আর বোরকার বেইজ্জতি করে। সারাজীবন খোলামেলা ঘুইরা বেরাইছ, এখন পর্দা কইরা কি ছাই করবা। এত ভালো হওয়ার দরকার নেই; আগে কেমন ছিলি, কী করতি তা তো আমরা ভালো করেই জানি! ইত্যাদি নানান জনের নানা ধরনের কথা শুনলে মনের অজান্তেই প্রশ্ন জাগে, আসলেই আল্লাহ কি আমার অপরাধ মাফ করবেন? সেইসাথে একটু শিথিলতা কাজ করতে থাকে এবং মানসিক শক্তি কমতে থাকে। সেই মুহূর্তগুলোতে আমার করণীয় কী? আমার জবাব কী হওয়া উচিত? কীভাবে আমি অবিচল থাকব?

উত্তর : আপনার মামি-চাচিদের খোঁচা দেয়া খুবই দুঃখজনক এবং অন্যায় কাজ। কোনো ব্যক্তি আগে কোনো গোনাহ করলে এর থেকে বের হতে পারবে না বা পরে আর ভালো কাজ করতে পারবে না বিষয়টি এমন নয়।

আল্লাহ চান, তাঁর বান্দী এবং বান্দাগণ যত বড় পাপই করুক না কেন, সে যেন এ পাপ থেকে ফিরে আসে। সে যেন তওবা করে ভালো পথে চলা শুরু করে। আমরা যে বলি, মানুষ আল্লাহর দরবারে গোনাহ থেকে তওবা করে, এ তওবার মানেই হল ফিরে আসা। ইসলামে তওবার বিধান রাখাই হয়েছে মূলত গোনাহগারদের জন্য। যে সৎপথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে সে-ই তো সৎপথে ফিরে আসবে।

কুরআনে আল্লাহ বিভিন্ন জায়গায় জঘন্য পাপী ব্যক্তিদের ফিরে আসার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। ফিরে এসে সঠিক পথে চলা শুরু করলে তাদের পূর্ববর্তী গোনাহ মাফ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

وَالَّذِیْنَ  اِذَا فَعَلُوْا فَاحِشَۃً اَوْ ظَلَمُوْۤا اَنْفُسَهُمْ ذَکَرُوا  اللهَ  فَاسْتَغْفَرُوْا لِذُنُوْبِهِمْ   ۪ وَمَنْ یَّغْفِرُ الذُّنُوْبَ اِلَّا اللهُ    ۪۟ وَلَمْ یُصِرُّوْا عَلٰی مَا فَعَلُوْا وَهُمْ یَعْلَمُوْنَ.

এবং তারা সেই সকল লোক, যারা কখনো কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে বা (অন্য কোনোভাবে) নিজেদের প্রতি জুলুম করলে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার ফলশ্রুতিতে নিজেদের গোনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে আর আল্লাহ ছাড়া আর কেইবা আছে, যে গোনাহ ক্ষমা করতে পারে? আর তারা জেনেশুনে তাদের কৃতকর্মে অবিচল থাকে না।

সূরা আলে ইমরান (০৩) : ১৩৫

সুতরাং আপনি ওসব নেতিবাচক কথায় কান দেবেন না। তাদের কথার উত্তরও দেবেন না। তাদের সাথে খারাপ ব্যবহারও করবেন না। সংকল্পবদ্ধ হয়ে ইসলামের উপর চলতে থাকুন।

ইনশাআল্লাহ পরম করুণাময় আল্লাহ পেছনের গোনাহ মাফ করে দেবেন এবং শরীয়তের ওপর চলা সহজ করে দেবেন।

৩. প্রশ্ন :স্বামীর অনুমতি ছাড়া কি দ্বীন শিখতে যেতে পারব? কারণ সে কিছুটা বদমেযাজি, দ্বীন-শরীয়ত মানে না। আমাকে নিষেধ করে।

উত্তর : দ্বীন শেখার বিভিন্ন স্তর রয়েছে। প্রথম স্তর হচ্ছে ফরযে আইন স্তর। যেখানে ঈমানের জরুরি বিষয়াদি নামায, রোযা, হজ্ব যাকাত (সম্পদশালী হলে), কুরআন মাজীদের সহীহ-শুদ্ধ তিলাওয়াত এবং নারীদের ক্ষেত্রে তাদের একান্ত বিষয়গুলোর শরয়ী সমাধানের ইলম অর্জন করতে হয়। এ পরিমাণ ইলম অর্জন করা সকল মুসলমানের কর্তব্য। এমনকি মা-বাবা অথবা স্বামী বাধা প্রদান করলেও এতটুকু পরিমাণ ইলম অর্জনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। কারণ, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের নির্দেশের বাইরে যদি কেউ কোনো নির্দেশ প্রদান করে তাহলে তা প্রত্যাখ্যাত হয়। শরীয়তের ভাষায়

لا طاعةَ لِمَخْلوقٍ في مَعصيةِ الله عزوجل.

সৃষ্টিকর্তার অবাধ্য হয়ে সৃষ্টিকুলের আনুগত্য করার সুযোগ নেই।

আর এই জরুরি স্তরের বাইরে আরও বেশি দ্বীনী ইলম অর্জন করার (যেটি অনেক ক্ষেত্রেই ফরজে কেফায়া স্তরে পড়ে) জন্য পিতা-মাতা বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে স্বামীর অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন আছে। তারা যদি যৌক্তিক কারণে এতে বাঁধ সাধে তাহলে সে পর্যায়ের ইলম হাসিল করা আপতত মুলতবি রাখবে, আবার তাদেরকে বুঝিয়ে সম্মত করার পর পুনরায় শিক্ষা হাসিল করা শুরু করবে।

৪. প্রশ্ন : আমার আশপাশটা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন, তাই আমাকে প্রায়ই খুব বিপাকে পড়তে হয়। আমার স্বামী একদিন আমাকে বলে, আমার পায়ে যদি তোমার চুল ঘুরে নাও তাহলে তোমার গোনাহ মাফ হয়ে যাবে! মা খাদিজা নাকি এমন করতেন?

উত্তর : উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদীজা রা. এমনটি করেছেন, এমন কথা কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া যায়নি। এটি মানুষের বানানো কথা। স্বার্থপর লোকেরা মনগড়া তথ্যের আবিষ্কারক। আপনার ওই কুসংস্কারে কান দেয়ার দরকার নেই। তবে ওই বিশ্বাস মনে রাখা ছাড়া স্বামীর চাপে পড়ে আপনি এ কাজটি করলে গোনাহগার হবেন না।

 

টীকা :

১। সায়্যিদুল ইস্তিগফার হল,

اللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّي لاَ إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ، خَلَقْتَنِي وَأَنَا أَمَتُكَ، وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ، أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ، أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ، وَأَبُوءُ لَكَ بِذَنْبِي فَاغْفِرْ لِي، إِنَّهُ لاَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا أَنْتَ.

হে আল্লাহ! আপনি আমার প্রভু। কোনো মাবুদ নেই আপনি ছাড়া। আপনিই সৃষ্টি করেছেন আমাকে। আপনারই বান্দা আমি। যথাসম্ভব আপনার সঙ্গে কৃত প্রতিজ্ঞা ও প্রতিশ্রুতির উপর অটল আছি। যে মন্দ কাজ আমি করেছি তার  মন্দ পরিণাম থেকে আপনার কাছে আশ্রয় কামনা করছি। আমি স্বীকার করছি আপনি প্রদত্ত নিআমতের কথা। স্বীকার করছি আমার গোনাহের কথা। তাই আমাকে ক্ষমা করুন। আপনি ছাড়া ক্ষমা করার আর কেউ নেই।

ফযীলত : যে ব্যক্তি দিনের বেলা পূর্ণ ইয়াকীন ও বিশ্বাসের সঙ্গে  সায়্যিদুল ইস্তিগফার পড়ে আর সেদিন সন্ধ্যার পূর্বে তার মৃত্যু হয় তাহলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। যে ব্যক্তি রাতের বেলা পূর্ণ ইয়াকিন ও বিশ্বাসের সঙ্গে এ ‍দুআ পড়ে আর সকারের পূর্বেই তার মৃত্যু তাহলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।

 

 

advertisement