জুমাদাল আখিরাহ ১৪৪৩   ||   ফেব্রুয়ারি -এপ্রিল ২০২২

নারীশিক্ষা ও একটি চমকপ্রদ ঘটনা

মাওলানা আতাউল্লাহ আব্দুল জলীল

আমার নানু ছিলেন কারী ইবরাহীম সাহেব রাহ.-এর বড় সাহেবজাদা মাওলানা ইসমাঈল সাহেবের কন্যা। নানুজির দিন শুরু হত তাহাজ্জুদ দিয়ে। ফজর বাদ কুরআন তিলাওয়াত ও মুনাজাতে মকবুল পাঠ ছিল তাঁর নিত্যদিনের অভ্যাস। ইশরাকের পরে শুরু করতেন সাংসারিক কাজ। যিকির-তাসবীহ মুখে লেগে থাকত। সূরা ইয়াসীন, সূরা ওয়াকিয়া, সূরা মুযযাম্মিল, সূরা কাহ্ফের কিছু কিছু অংশ নানুর নিয়মিত তিলাওয়াত শুনেই আমাদের মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। ঘুমের দুআ, ওযুর আগে-পরের দুআ, অশ্রুসজল চোখে বিদায় বেলার দুআও তাঁর কাছ থেকে শুনে শুনেই কেবল মুখস্থই নয়, বরং হৃদয়ে খোদিত হয়ে গেছে। নানুর মুখেই শুনেছি আল্লাহভীরু মহিউদ্দীন আওরঙ্গজেবের অসাধারণ গুণবতী কন্যা জেবুন্নেসার গল্প। কতবার যে শুনেছি তার কোনো হিসাব নেই। বড় আবেগভরা কণ্ঠে তার বাবার মুখ থেকে শোনা এই ঘটনা নানু আমাদের শোনাতেন এবং নাতি-নাতনিদের পড়ালেখার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন। ঘটনাটি এমন

একদিন বাদশাহ আলমগীর ঘরে এলেন। চেহারায় চিন্তার ছাপ। বাবার চেহারা দেখেই গুণবতী কন্যা বিষয়টি আঁচ করে ফেললেন। তাই তিনি ঘরোয়া আলাপচারিতায় বাবার মন হালকা করার চেষ্টা করলেন। কথায় কথায় চিন্তার কারণটাও জেনে নিলেন। চিন্তার কারণ একটি ঘটনা। ঘটনাটি হলইরানের রাজকবি একটি চরণ তৈরি করেছেন। পরের চরণটি আর মেলাতে পারছেন না। তাই বাদশাহকে বিষয়টি পেশ করেছেনতিনি যেন দেশের জ্ঞানী-গুণীদের একত্র করে চরণের দ্বিতীয় অংশটি পূর্ণ করে দেন। কবির মনোবাসনা পূরণার্থে বাদশাহ ইরানের গুণীজনদের সমবেত করলেন। কবির সেই অসম্পূর্ণ চরণটি যে পূর্ণ করে দিতে পারবে তাকে বড় ধরনের পুরস্কার ও মর্যাদায় ভষিত করা হবে বলে ঘোষণা দিলেন। জ্ঞানী-গুণীজন দীর্ঘ প্রচেষ্টার পরও এর কোনো সুরাহা করতে পারেননি। তাই নিরুপায় হয়ে ইরানের বাদশাহ সম্রাট আওরঙ্গজেবের দ্বারস্থ হন। আওরঙ্গজেব তাঁর সভাসদ ও জ্ঞানী-গুণীজনদের সম্মুখে বিষয়টি উপস্থাপন করেন, কিন্তু তারাও ওই চরণের অপর চরণটি তৈরি করতে ব্যর্থ হন। সেই চিন্তা মাথায় নিয়ে বিমর্ষচিত্তে সম্রাট প্রবেশ করেন অন্দর মহলে। বাবার চিন্তিত চেহারা দেখে জেবুন্নেসা বিনীতভাবে জানতে চান সেই চরণটি কী? সম্রাট বড় হতাশার সূরে বললেন চরণটি হল

در ابلق کسے کم ديدہ موجود

সাদা-কালো মোতির দর্শন পেয়েছে এমন মানুষ বিরল।

এই চরণটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে স্বতঃস্ফর্তভাবে জেবুন্নেসার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল পরের চরণটি

مگر اشک بتان سرمہ آلود

তবে রমণীর সুরমা মাখা অশ্রুবিন্দু (অর্থাৎ রমণীর সুরমা মাখা অশ্রুবিন্দু হল সাদা-কালো মোতি)।

মেয়ের মুখনিঃসৃত এই চরণখানা নিয়ে বাদশা গুণীজনদের সম্মুখে উপস্থাপন করলেন। সকলে এক বাক্যে তা সমর্থন করলেন। বড় যুৎসই হয়েছে বলে বাহ্ বাহ্ দিলেন। বাদশাহ প্রফুল্লচিত্তে ইরানের দূতের হাতে চরণটি তুলে দিয়ে সসম্মানে বিদায় জানালেন। দূত মারফত বাকি চরণটি পেয়ে ইরানের বাদশাহ যারপরনাই আনন্দিত হলেন এবং তার কবির সামনে পেশ করলেন। চরণটি পাওয়ার পর কবি তো আত্মহারা। তিনি বললেন, বাদশাহ নামদার! যিনি এই চরণ দিয়ে চরণটি পূর্ণ করেছেন নিশ্চয়ই তিনি বড় জ্ঞানী-গুণী, তাকে সংবর্ধনা জানানো এবং যথাযোগ্য পুরস্কারে ভষিত করা আমাদের কর্তব্য।

বাদশা বললেন, অবশ্যই।

ইরানের দূত আবার এসে হাজির আওরঙ্গজেবের দরবারে। যে মহাজ্ঞানী কবিতার এই চরণটি তৈরি করেছেন ইরানবাসী তাকে এক নজর দেখতে চায়। এই প্রস্তাবে বাদশাহ আলমগীর তো পড়লেন মহা বিপদে। এর জবাব তিনি কী দেবেন। বাদশার অন্দর মহলের এক গুণবতী নারীর এই কৃতিত্বের কথা তো আর তিনি ইরান শাহের নিকট উল্লেখ করেননি। সমাধানের জন্য তিনি আবার গেলেন তার গুণবতী কন্যার নিকট। কন্যাও আরেকটি চরণ দিয়ে এই সমস্যার সমাধান দিয়ে দিলেন

درسخن مخفی منم چوں بوئے گل دربرگ گل + ہرکہ دیدن ميل دارد درسخن بيندمرا

ফুলের ঘ্রাণের মতো আমিও লুকিয়ে আছি আমার কথামালায়।

                                          যে আমায় দেখতে চায়, সে যেন আমার চরণেই আমাকে দেখে নেয়।

এ ঘটনা দ্বারা বোঝা যায়, মুসলিম বাদশাহগণ নারী শিক্ষার প্রতি কতটা যত্নবান ছিলেন এবং মুসলিম সমাজের নারীগণ কী পরিমাণ জ্ঞানসাধনা করতেন।

 

নানুজী রাহমাতুল্লাহি আলাইহা

মাওলানা আফফান মুহাম্মাদ

আমার নানু... আমাদের নানু। অনেকের দাদু। আবার কারো মা-জননী। মুহতারাম শাইখুল হাদীস রাহ.-এর সহধর্মিণী।

নানুর মাঝে কী না ছিল! ভালবাসা ও মহব্বত, স্নেহ ও শফকত, অবিরাম নামায ও ইবাদত, যিকির ও তিলাওয়াত, সবর ও সহনশীলতা, উদারতা-দানশীলতা। সবই ছিল তাঁর মধ্যে ঈর্ষণীয় পর্যায়ে। নানুজীকে দেখলেই মনে হত জান্নাত তো তাঁদের মতো মানুষের জন্যই! নানুর বাসায় গেলে সাধারণত দেখা যেত নানুজী হয় নামায পড়ছেন কিংবা তিলাওয়াত করছেন অথবা এক মনে যিকির করছেন।

কোথাও বেড়াতে বা দাওয়াতে গেলেও নানুজীর ইবাদতে কোনো রকম পরিবর্তন হত না, নামায ও তিলাওয়াত নিয়েই মশগুল থাকতেন; বিশেষত তখন নফল নামায অনেক বেশি পড়তেন।

কুরআন কারীমের প্রতি ভালবাসা

কুরআন কারীমের প্রতি ছিল নানুজীর অত্যধিক ভালবাসা। দৈনিক দীর্ঘ সময় তিলাওয়াতে কাটাতেন। আম্মুর কাছে শুনেছি, প্রতি মাসে নানুজী কমপক্ষে তিন-চারবার কুরআন কারীম খতম করতেন। রমাযানুল মোবারকে অন্যান্য ইবাদতের পাশাপাশি ১৩/১৪ বার খতম করতেন। অধিক পরিমাণ তিলাওয়াতের বদৌলতে নানুর  সামনে কেউ কুরআন কারীম ভুল পড়লে বলে দিতে পারতেন! অথচ নানুজী হাফেযা ছিলেন না।

নামাযের প্রতি মহব্বত

নামাযের প্রতি ছিল নানুজীর সীমাহীন টান ও ব্যাকুলতা, অনেক বেশি আগ্রহ ও একাগ্রতা, উদ্দীপনা ও মগ্নতা। সুযোগ পেলেই দাঁড়িয়ে যেতেন মহান রবের দরবারে, লুটিয়ে পড়তেন সিজদায়।

একবারের ঘটনা, নানুর বাসার অনেকেই পারিবারিক তরবিয়তে সফরে যাওয়ার নিয়তে একত্রিত হয়েছি। সবাই নানুর বাসার নিচে নানু নামার অপেক্ষা করছি। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর আমি উপরে উঠলাম নানুসহ নামার জন্য। গিয়ে দেখি, নানুজী নামায পড়ছেন, তিনি নামাযের বৈঠকে বসলে আমি লিফট কল করলাম। নামায শেষ হওয়ার পর আমরা লিফটের সামনে এসে দেখি লিফট নিচে চলে যাচ্ছে। নানুজী আমাকে বললেন, তুমি লিফট ডাকো, এরই মধ্যে আমি আরো দুই রাকাত নামায পড়ে আসি!

দানশীলতা

এটি ছিল নানুর অন্যতম এক মহৎ গুণ। প্রায় সময়ই অনেক মুহতাজ মা-বোন বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে নানুর কাছে আসতেন। নানু সর্বোচ্চ দিয়ে তাদের সহযোগিতার চেষ্টা করতেন। নিজের কাছে না থাকলে অন্যের কাছ থেকে ব্যবস্থা করে দিতেন। কাউকে খালি হাতে ফেরাতেন না। একবার পথের মধ্যে নানুজীর কাছে অসহায় দরিদ্র একজন সাহায্য চাইল। নানু নিজের কাছে যা ছিল দিলেন। পরিমাণ খুব বেশি ছিল না।

তখন সেই অসহায় মহিলা বলল, আমার ছেলে অসুস্থ। গরুর গোশত খেতে চেয়েছে। নানুজী তার কাছ থেকে বাসার ঠিকানা নিলেন। সম্ভবত কমলাপুরের দিকের কোনো বস্তিতে ছিল সে বাসা। বাসায় এসে রান্না করা গরুর গোশতের ব্যবস্থা করে নিজে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসেন!

দ্বীনের দাওয়াতে অক্লান্ত চেষ্টা

দ্বীনের দাওয়াতে অনেক সময় ব্যয় করতেন। সকল ব্যস্ততার পাশাপাশি নানুজী সুযোগ পেলেই দ্বীনের দাওয়াতে সময় দিতেন। আম্মুর কাছে শুনেছি, বাসায় অভাবী কেউ এলে নানু তার খাবারের ব্যবস্থা করতেন এবং কালেমা-নামায শেখাতেন। এভাবে সবসময় নানুজী দ্বীনের দাওয়াত দিতেন। মাস্তুরাতের মধ্যে তাবলীগের মেহনত করতেন মন-প্রাণ উজাড় করে। ঘরেও সর্বদা এই মেহনত অব্যাহত রাখতেন। নামাযের সময় হওয়ার পর মেয়েরা নামায আদায়ে বিলম্ব করলে রাগ করতেন। মাথায় ওড়না না থাকলে অসন্তুষ্ট হতেন। আযানের পর ছেলেরা মসজিদে যেতে দেরি করলে খুবই রাগ করতেন।

নানুজীর তরবিয়ত

তাঁর  তরবিয়তের ধরন ছিল খুবই সুন্দর ও অনুসরণীয়। আম্মুর ভাষায়, ছোটবেলায় আমাদের বাসার নিয়ম ছিল, নামায ফরয হওয়ার আগে ছেলে এবং মেয়েরা ভিন্ন ভিন্নভাবে আম্মার সামনে নামায পড়তে হত। নামাযের সকল তাসবীহ, সূরা-কেরাত জোরে জোরে পড়তে হত। আম্মা বসে বসে শুনতেন। ভুল হলে শুধরে দিতেন। এভাবে ধৈর্য সহকারে আম্মা আমাদেরকে প্রতিটি বিষয় শেখাতেন।

নানুজী রাহ. ইন্তেকালের পূর্বে কয়েক মাস বিভিন্ন অসুস্থতার কারণে দীর্ঘ তিলাওয়াতের মাধ্যমে নামায আদায় করতে পারতেন না। এটা নানুকে অনেক বেশি পীড়া দিত। এ কারণে সবসময় মন খারাপ করে থাকতেন। নানুজীকে নিয়ে বললে অনেক কথাই বলতে হয়। সংক্ষেপে বললে বলা যায়, নানুজী সূরা আহযাবের ৩৫ নং আয়াতে বর্ণিত গুণাবলি ধারণে সচেষ্ট ছিলেন সারাজীবন।

দুই বছরের একটু বেশি হল নানুজী মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউসের সুউচ্চ মাকাম দান করুন। আমাদেরকে তাঁর জীবনের উত্তম বিষয়গুলো অনুসরণের তাওফীক দিন আমীন।

 

 

advertisement