জুমাদাল আখিরাহ ১৪৪৩   ||   ফেব্রুয়ারি -এপ্রিল ২০২২

আল্লাহর হুকুম ও দ্বীন প্রতিষ্ঠায় নারী

মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া

نحمده ونصلي على رسوله الكريم، أما بعد:

فأعوذ بالله من الشيطان الرجيم،

 بسم الله الرحمن الرحيم:

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اسْتَجِیْبُوْا لِلهِ وَلِلرَّسُوْلِ  اِذَا دَعَاكُمْ لِمَا یُحْیِیْكُمْ   ۚ وَاعْلَمُوْۤا اَنَّ اللهَ یَحُوْلُ بَیْنَ الْمَرْءِ وَقَلْبِهٖ وَاَنَّهٗۤ  اِلَیْهِ تُحْشَرُوْنَ.

হে মুমিনগণ, রাসূল যখন তোমাদেরকে এমন কিছুর দিকে আহ্বান করেন যা তোমাদেরকে প্রাণবন্ত করে, তখন তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আহ্বানে সাড়া দাও এবং জেনে রাখ, আল্লাহ মানুষ ও তার অন্তরের মাঝে অন্তরায় হন। আর নিশ্চয় তাঁর নিকট তোমাদেরকে একত্র করা হবে। সূরা আনফাল (০৮) : ২৪

আল্লাহ তাআলার প্রতিটি হুকুমই তাঁর পক্ষ থেকে একেকটি আহ্বান। যেমন একটি হুকুম হল নামায। নামাযের সময় হাইয়া আলাস সালাহ, হাইয়া আলাল ফালাহ বলে আহ্বান করা হয়। অর্থাৎ এসো কামিয়াবীর দিকে, এসো কল্যাণের দিকে। 

মহান রবের প্রতিটি হুকুম তাঁর নিকটবর্তী করে দেয়। তাই প্রতিটি হুকুম যেন আল্লাহর সঙ্গে যুক্ত থাকার একেকটি বন্ধন। আমরা যদি তাঁর আহকাম পালন করি তাহলে তাঁর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক মজবুত হবে।

সুতরাং যারা আল্লাহর হুকুম মান্য করে তারা তাঁর খুবই নিকটবর্তী। তদ্রূপ যে যত সুন্নত-শরীয়তের উপর আমল করবে সে ততটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরও  নিকটবর্তী হবে।

আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠায় এবং নবীদের সহযোগিতায় নারী

নবীদের সাহায্যকারী হিসেবে সবসময়ই নারীদের ভূমিকা ছিল অনন্য। হযরত ইবরাহীম আ. ও হযরত ইসমাঈল আ. কাবা নির্মাণ করেছেন। আল্লাহ তাআলা এর পটভূমি তৈরি করেছিলেন হাজেরা আ.-কে দিয়ে। সেখান থেকে উৎসারিত হয়েছে জমজম কপ। বায়তুল্লাহর আবাদী সেখান থেকেই শুরু। দুনিয়াতে যে কোনো জিনিসের আবাদীতে নারীদের ছোঁয়া আছে। দুনিয়াতে একটি ঘর আবাদ করতে নারীদের প্রয়োজন। চাই সে মা হোক, স্ত্রী হোক, বোন হোক। তাদের মাধ্যমেই ঘর আবাদ থাকে। তদ্রূপ আল্লাহর হুকুম ও দ্বীন প্রতিষ্ঠায় নারীদের ভমিকা ও সহায়তা রয়েছে শুরু থেকেই। মক্কা মুকাররমায় কত মানুষ তওয়াফ করছে, কত ইবাদত হচ্ছে কিন্তু গোড়াতে এর আবাদীতে আল্লাহ যাদের শ্রম ও কুরবানী নিয়েছেন তাদের অন্যতম হলেন, একজন নারী। তিনি হলেন হাজেরা আ.। এই যে সাফা-মারওয়ার মাঝে দৌড়াতে হয়, এ দৌড় মা হাজেরা আ.-এরই স্মৃতি বহন করে। তাঁর এই দৌড় ছিল সন্তানের পানির জন্য, এতৎসত্তে¡ও এই দৌড়ও আল্লাহর জন্যই। কারণ তাদের মক্কায় অবস্থানই ছিল আল্লাহর হুকুমে ও আল্লাহর জন্য। হাদীসে এই ঘটনা সবিস্তারে এসেছে। একদা ইবরাহীম আ. তাঁর স্ত্রী হাজেরা এবং দুগ্ধপোষ্য সন্তান ইসমাঈল আ.-কে বাইতুল্লাহর কাছে জনমানবহীন এলাকায় রেখে চলে আসেন। যখন ইবরাহীম আ. তাদেরকে রেখে চলে যাচ্ছেন; মা হাজেরা বললেন, এই মরুভমিতে আমাদেরকে রেখে যাচ্ছেন! এখানে তো কেউ নেই, জনবসতি নেই, আমাদের খাবার-দাবারের ব্যবস্থা নেই। তো আপনি আমাদেরকে এই অবস্থায় রেখে যাচ্ছেন!

হযরত ইবরাহীম আ. কোনো কিছুই শোনেন না। তিনি তাদের রেখে আল্লাহর হুকুম পালনার্থে রওনা হয়েছেন। তখন হাজেরা আ. বললেন, এটা কি আল্লাহ তাআলার হুকুম?

ইবরাহীম আ. বললেন, হাঁ, এটা আল্লাহর হুকুম।

তখন হাজেরা আ. বলেছিলেন,

إذالايضيعنا.

তাহলে আল্লাহ আমাদের ধ্বংস করবেন না।

ছোট্ট একটি কথা। কিন্তু ঈমান কোন স্তরের হলে, কত মজবুত আস্থা এবং বিশ্বাস থাকলে জনমানবহীন মরুভমিতে একটি দুগ্ধপোষ্য শিশুকে নিয়ে একজন নারী এ কথা বলতে পারেন। এঁরাই আমাদের আদর্শ মা। আদর্শ নারী।

তিনি যে বললেন, আল্লাহ আমাদের ধ্বংস করবেন না। বিষয়টি তাহলে কী? ধ্বংসের সমস্ত উপকরণ এখানে মজুদ! এখানে জনবসতির কোনো চিহ্ন নেই! রাতে কোনো হায়েনা বা বিষাক্ত প্রাণী দংশন করতে পারে। দিনের বেলায় সূর্য উদিত হলে মরুভমির তাপ থেকে রক্ষার কোনোই উপায় নেই! তাহলে দেখা যাচ্ছে বাহ্যত ধ্বংসের সকল ব্যবস্থা এখানে বিদ্যমান! কিন্তু হাজেরা আ. বললেন

إذالايضيعنا.

তাহলে আল্লাহ আমাদের ধ্বংস করবেন না

এটা আল্লাহর হুকুম হলে আমাদের ধ্বংস বা ক্ষতি হবে না। আল্লাহর হুকুমের ভেতরে আবাদি আছে, জীবন আছে, স্থায়িত্ব আছে। এ কথাই বলা হয়েছে সূরা আনফালের উক্ত আয়াতে।

আজকাল মানুষ Established হতে চায়। কিন্তু অনেকেই বোঝে না কীভাবে Established হওয়া যাবে। বাস্তবে Established হওয়া দ্বীনের মাঝেই নিহিত আছে। আল্লাহর হুকুম মানার ভেতরেই রয়েছে। স্থায়িত্ব মূলত আল্লাহর হুকুম মানার ভেতরে। যেদিন দুনিয়ায় আল্লাহর হুকুম থাকবে না, ঈমানের কোনো চিহ্ন থাকবে না সেদিন কিয়ামত হয়ে যাবে। হাদিস শরীফে এসেছে

لا تقوم الساعة حتى لا يقال في الأرض : الله الله.

পৃথিবীতে যতক্ষণ আল্লাহ আল্লাহ বলা হবে ততদিন কিয়ামত কায়েম হবে না। সহীহ মুসলিম, হাদীস   ১৪৮

সুতরাং যতদিন আল্লাহ আল্লাহ বলার মতো এতটুকু ঈমান থাকবে, এতটুকু জিকিরের আহকাম বাকি থাকবে, ততদিন আল্লাহ তাআলা এই দুনিয়াকে ঠিক রাখবেন। তাহলে এই দুনিয়ার হায়াত এবং দুনিয়ার রূহ হল ঈমান ও আল্লাহর হুকুম। রূহ হল, ঈবাদত ও আহকাম।

আমরা তো এখন জনবসতিতে থেকে আল্লাহর হুকুম মানছি। তাঁরা এমন সময় আল্লাহর হুকুম মেনেছেন যখন হুকুম পালন করতে গিয়ে তাঁরা সামনে মৃত্যু দেখেছেন। হাজেরা আ. এমন সময় আল্লাহ তাআলার হুকুম মেনেছেন, যখন মরুভূমির ভেতরে জীবন ধারণের কোনো উপকরণ ছিল না।

আমাদেরকে যদি আল্লাহর হুকুমে রেখে যান, তাহলে আমরা ধ্বংস হব না।

কেননা আল্লাহর হুকুমে জীবন আছে। আজ একথার বাস্তবতা দেখুন। ইবরাহীম আ. তাঁর স্ত্রী, সন্তানসহ সবাই মিলে অর্থাৎ পুরো পরিবার মিলে মহান আল্লাহর হুকুম পালন করলেন। তাদের এই বংশের সফলতা ও স্থায়িত্ব দেখুন, আল্লাহ তাআলা এই বংশ থেকে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করলেন। যেই স্থানে আহকাম পালিত হল ঐ স্থানের আবাদী দেখুন! কত ইবাদত, কত যিন্দেগী, কত ক্ষমা ওখানে রয়েছে! কত মানুষের জান্নাত ওখানে রয়েছে! শুধু একটি পরিবারের ত্যাগের মাধ্যমে। আমরা নিজেদেরকে নিয়ে যদি চিন্তা করি, আল্লাহ তাআলার কত আহকাম আমরা জানি, কিন্তু ওসবের উপর আমরা আমল করতে পারছি না। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাঁর সকল আহকামের উপর আমল করার তাওফীক দান করুন। আসলে দুনিয়াতে একটি পরিবার শুধু বাড়ি-গাড়ি ইত্যাদি দিয়ে আবাদ ও Established হয় না; বরং দুনিয়া ও আখেরাতের স্থায়িত্ব মূলত আল্লাহর আহকাম মানার মধ্যেই রয়েছে।

আল্লাহ রব্বুল আলামীন আমাদেরকে একটি দুআ শিখিয়েছেন, দেখুন এতে কত সুখ আছে, কত জীবন আছে।

رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا.

হে আমাদের রব। আমাদের এমন স্ত্রী-পরিজন, সন্তান-সন্ততি দান করুন, যারা আমদের জন্য চোখের শীতলতা হবে। আর আপনি আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্য অনুসারী করুন।

সূরা ফুরকান (২৫) : ৭৪

এই দুআর মধ্যে কত শান্তি রয়েছে, সন্তান হল, কিন্তু সন্তান মা-বাবার আতঙ্কের কারণ হল কিংবা কষ্টের কারণ হল, তাহলে কী লাভ! বাবার অনেক প্রপার্টি আছে, অনেক জমি আছে, ব্যাংক-ব্যালেন্স আছে, কিন্তু সন্তান এমন যে, বাবার সঙ্গে যুদ্ধ লেগে থাকে। নাউজুবিল্লাহ! তো একটা ছোট্ট দুআর সাথে দুনিয়ার সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানকে তুলনা করুন দেখবেন এই দুআর ওজন কত, পাওয়ার কত, সৌন্দর্য কত। কত প্রাণ আছে এর ভেতরে। কত সুখ আছে কল্পনাই করা যায় না। আল্লাহ আমার স্ত্রী-পুত্র পরিজনকে আমার চোখের শীতলতা বানান। আমি ঘরের প্রধান তাই আমার ঘর যেন মুত্তাকীর ঘর হয়। মুত্তাকীদের প্রধান বানান আমাকে। যেন আমরা পুরো পরিবার মিলে আপনার আহকাম পালন করতে পারি। সবাই যেন আপনার সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। এমন একটি পরিবার দুনিয়াতে থেকেই জান্নাতী পরিবার।

অনুলিখন, মাওলানা খায়রুল বাশার

 

 

advertisement