প্রিয়জনের মৃত্যু
আমার শাশুড়ির মৃত্যু আমার অন্তরকে উলট-পালট করে দিয়ে গিয়েছে। এই মৃত্যু আমার ভাবনার খোরাক হয়েছে। আমি তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। আপন করে উপলব্ধি করেছি। তাঁকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া, ছেলেরা তাকে কাঁধে বহন করা⸺ সব দৃশ্যই আমার চিন্তার খোরাক হয়েছে।
আমি শুধু কাঁদছিলাম। সবাই অবাক হয়ে আমাকে দেখছিল। আমার হালত কেউই বুঝতে পারছিল না।
সা‘দের আব্বু মুফতী সাহেবের ইচ্ছায় মৃত্যুর পরদিনই মীরাস বণ্টন হয়। তিনি চাচ্ছিলেন, নিজ হাতে মায়ের মীরাস বণ্টন করে যাবেন। কারণ মানুষ মারা যাওয়ার সাথে সাথেই ওয়ারিশগণ রেখে যাওয়া সম্পদের মালিক হয়ে যায়। এমতাবস্থায় একে-অন্যের সম্পদ ব্যবহারের অবকাশ নেই। তাই মৃত্যুর সাথে সাথে যত তাড়াতাড়ি সম্পদ বণ্টন করা যায় ততই ভালো।
আমি শাশুড়ি মায়ের একটা সুতি শাড়ি, হাতে সেলাই করা জায়নামায ও মায়ের অতি প্রিয় কাঠের রিহালটি লাভ করি এবং স্মৃতিস্বরূপ নিয়ে আসি।
তিনি ছিলেন আমার একজন ভালবাসার মানুষ। তিনি আমাকে অসম্ভব ভালবাসতেন। আমিও তাঁকে ভালবাসতাম। বিদায়ের সময় প্রতি বারই তিনি খুব কাঁদতেন। আমিও কাঁদতাম। দুজনই দুজনের কাছে ক্ষমা চাইতাম।
আমি বলতাম, ‘আমি আপনার কাছে থাকতে পারছি না। আপনার কোনো খেদমত করতে পারছি না। আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।’
তিনি বলতেন, ‘আমি তোমার জন্য কিছুই করতে পারছি না। তোমাকে কিছুই দিতে পারছি না। নাতিদের জন্যও কিছু করতে পারছি না। নাতিদের একটু কোলেও নিতে পারি না।’
এভাবেই দুজন দুজনার অন্তরের অনুশোচনা নিয়ে কথা বলতাম। মায়া অনুভব করতাম।
সবসময় শ্বশুরবাড়ি থেকে কাঁদতে কাঁদতে ঢাকা ফিরে আসতাম। তিনি আমাদের বিদায় দিতে দাঁড়িয়ে থাকতেন। যতক্ষণ আমাদের দেখা যেত তাকিয়েই থাকতেন। আমার এ কান্না ঢাকা পৌঁছা পর্যন্তই চলতে থাকত।
একবার নানা বাড়ি থেকে আমার আম্মুসহ ঢাকা ফিরছিলাম। ফেরার পথে আমার শ্বশুরবাড়ির পথের দিকে নজর পড়তেই অজান্তেই কান্না চলে আসে। আমাকে নিয়ে সবাই তখন সে কী হাসাহাসি! শ্বশুরবাড়ির জন্য কেউ কাউকে এভাবে কাঁদতে দেখেনি।
তিনি আমাকে এতটাই ভালবাসতেন যে, আমার পেছনে কেউ আমাকে নিয়ে কোনো মন্তব্য করলেও তিনি পছন্দ করতেন না। এক অনুষ্ঠানে কেউ আমার ব্যাপারে মন্তব্য করল। মন্তব্যকারী চলে যাওয়ার পর আমার শাশুড়ি বললেন, ‘দেখলি, এরা ছোট বৌমাকে হিংসা করে।’
তাঁকে হারিয়ে সবচে বড় যে জিনিসটি আমি হারিয়েছি, আমি ও আমাদের সন্তানদের জন্য মহান রবের দরবারে তাঁর হৃদয় নিংড়ানো ফরিয়াদ। তিনি সবসময় বলতেন, ‘আমি তোমাদের জন্য কিছুই করতে পারিনি। তোমাদেরকে কিছু দিতেও পারিনি। তবে তোমাদের জন্য আমি সবসময় দুআ করি। আল্লাহ তোমাদেরকে দেবেন।’
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তাঁর মৃত্যুর পর মহান আল্লাহ তাআলা আমাদের যা কিছুই দিয়েছেন, তাঁর হৃদয় নিংড়ানো দুআরই ফসল। তিনি বেঁচে থাকলে এসব দেখে খুব খুশি হতেন।
তাঁর মৃত্যুর পর যখনি শ্বশুরবাড়ি গিয়েছি তাকে অনুভব করেছি। তিনি ছিলেন বিশাল বটবৃক্ষের মতো। এখন ছায়াবিহীন শূন্য ভিটা পড়ে আছে। যেন ধু-ধু এক মরুভূমি।
তাঁর মৃত্যু আমাকে অনেক কিছু শিখিয়ে গিয়েছে। আমি যা ব্যক্ত করতে পারব না। আমার জীবনে এর প্রতিফলন দেখতে পেয়েছি। আমৃত্যু সে শিক্ষা কাজে লাগানোর চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ!