শাবান-শাওয়াল ১৪৪৪   ||   মার্চ-মে ২০২৩

যে কারণে সংসারগুলো ভেঙে যাচ্ছে
একজন ভুক্তভোগী নারীর অনুভূতি ও কিছু কথা

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

লেখার চাপ চারদিক থেকে। আলকাউসারের বিভিন্ন বিভাগ থেকে লেখা চাওয়া হয়। আনওয়ারুল কুরআন বিভাগ থেকে চাওয়া হয়। আলকাউসারের দুই সাপ্লিমেন্ট শিশু-কিশোর ও নারী পত্রিকা থেকেও তাগাদা আসে। আমি তো আসলে লেখক নই। লেখার জন্য আলাদা সময়ও নেই আমার। অন্যান্য কাজের ফাঁকে দুয়েক কলাম লেখা বা বলা হয়। কাজের প্রয়োজনে দেশ-বিদেশের যে সকল সংবাদপত্রে নিয়মিত চোখ বুলানো হয়সেগুলোর একটিতে এ মুহূর্তে নজর পড়ল। একটি খবরে বর্তমান সময়ে অমুসলিম বিশ^ তো বটেই, মুসলিম দেশগুলোতেও কেন তালাক ও বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে তা নিয়ে কথা বলেছেন পাকিস্তানের শোবিজ জগতের এক মহিলা। সম্প্রতি তাঁর দ্বিতীয় বিবাহ হয়েছে। যে কারণগুলো মহিলাটি বলেছেন সেগুলো দেখে মনে হলো, এ বিষয়ে দুয়েকটি কথা বলার মতো আছে। সামনে বসা আছেন আলকাউসার নারী পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক মাওলানা ওয়ালিউল্লাহ। তিনি বললেন, এ বিষয়ে নারী পত্রিকার জন্য কিছু লিখুন। তাই অন্য কাজের ফাঁকে দুচারটি কথা আরজ করছি।

বিবাহ বিচ্ছেদের পরিমাণ অব্যাহতভাবে বেড়ে যাওয়া নিয়ে মাসিক আলকাউসারে (যিলহজ¦ ১৪৩৮/সেপ্টেম্বর ২০১৭) আগেও কিছু লেখা হয়েছিল। তাই আজকে এ বিষয়ে বিশদ কিছু বলছি না। আগ্রহী পাঠক চাইলে আগের লেখাটি ওই সংখ্যা থেকে পড়ে নিতে পারেন। আজ শুধু ওই নারী যে সব বিষয়ে কথা বলেছেন সেগুলোর বিষয়ে কিছু বলছি।

দৈনিক জঙ্গে (১০ জানুয়ারি ২০২৩) প্রকাশিত বক্তব্যে নাদিয়া খান বলেছেন, দীর্ঘ দিন পর দ্বিতীয় বিবাহ হওয়ায় এখন তার জীবন সহজ ও আরামদায়ক হয়েছে। আগে একাই সন্তানদের সামাল দিতে হতো, যা ছিল কঠিন বিষয়। দ্বিতীয় বিবাহের পর জীবনসঙ্গী মিলায় বিষয়টি সহজ হয়েছে।

এরপর তিনি অব্যাহতভাবে সমাজে তালাকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণকে দায়ী করেছেন। তাঁর মতে অবিশ্বস্ততা ও আস্থাহীনতা, মেয়েদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া, নারীরাই নারীর শত্রু হয়ে ওঠা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অবাধ বিচরণ বর্তমানে তালাকের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।

এ মহিলার নাম সম্ভবত আমি প্রথম শুনছি। তবে এসব জগতের নারী-পুরুষদের যে অসংখ্য ভক্ত থাকে তা তো এখন জানা কথা। কেউ কেউ তাদেরকে স্টার, সেলিব্রেটিও বলে থাকে। যাই হোক নাদিয়া খানদের কর্ম ও পেশা নিয়ে আমাদের ধারণা কেমন তা তো পাঠকের কাছে ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু মহিলাটি যে বিষয়ে কথা বলেছেন আমার মনে হয়, তার চিন্তাগুলোতে ভাবনার খোরাক রয়েছে। যেমন : তিনি প্রথম বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পরের নিঃসঙ্গ জীবন এবং দ্বিতীয় বিবাহের পরের সময়ের মূল্যায়ন করতে গিয়ে নিঃসঙ্গ জীবনকে কঠিন আখ্যা দিয়েছেন। বিষয়টি তো খুব স্পষ্ট।

এটা ঠিক যে মানুষের প্রথম বিবাহ স্থায়ীভাবে টিকে থাকাই কাম্য। তবুও কোনো কারণে যদি বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে যায় অথবা স্বামী/স্ত্রীর ইন্তেকাল হয়ে যায় তাহলে যথাসম্ভব তাদের আবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া শরীয়তের দৃষ্টিতেও কাম্য। বিভিন্ন কারণ বা হিকমতে ক্ষেত্র বিশেষে এর ব্যতিক্রমও হতে পারে। নির্ভরযোগ্য আলেম ও বিজ্ঞজনদের থেকে এ বিষয়ে দিক-নির্দেশনাও নেওয়া যেতে পারে। তবে সাধারণ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বিবাহিত জীবন বহু কারণেই শরীয়তে কাম্য। এ ক্ষেত্রে মহিলাটি মাত্র একটি বিষয় উল্লেখ করেছেন। তা হচ্ছে, ঘরোয়া কাজ-কর্ম ও সন্তানাদি লালন-পালনে অংশীদার পাওয়া। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর সাথে রয়েছে, আর্থসামাজিক নিরাপত্তা, সতীত্ব ও চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষার মতো বিষয়গুলোও। বাংলা, পাক, ভারত উপমহাদেশে এ বিষয়ে প্রচলিত সংস্কৃতি কিন্তু উল্টো। অনেক ক্ষেত্রেই স্বামী বা স্ত্রী বিয়োগ ঘটলে নতুন বিবাহকে উৎসাহিত করা হয় না। অনেকে বাঁকা চোখেও দেখে থাকে। পেছনে পেছনে সমালোচনাও করে থাকে। তবে কিছু দিন আগে শুনেছি, কোনো কোনো সন্তান তাদের মা/বাবার বিয়ের আয়োজনও করেছে। এটি উৎসাহ ব্যাঞ্জক। সমাজের ভুল প্রথাগুলো সংশোধন হওয়া উচিৎ। অন্তত প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে একাকি থাকা নারী ও পুরুষদের দ্বিতীয় বিবাহকে উৎসাহিত করা সময়ের দাবি। এ বিষয়ে বিস্তারিত বলার অনেক কিছুই আছে। আজকের সংক্ষিপ্ত সময়ে যা সম্ভব হচ্ছে না।

যে বিষয়ের জন্য এ লেখার অবতারণা সেটি হচ্ছে, আমাদের এসকল দেশেও তালাকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণ। এ রোগটি আসলে আমাদের ছিল না। এটি পশ্চিমা বিশ্ব থেকে আমদানি হয়েছে। এমন নয় যে এলসি খুলে প্যাকেট বন্দি করে একবারে আমদানি করা হয়েছে। বরং এর সাথে জড়িয়ে আছে বহু অনুসঙ্গ। যে অনুসঙ্গ ও জীবনাচরণগুলোর কারণে পশ্চিমা বিশ্ব তাদের পরিবার পদ্ধতি অনেকটা শেষই করে ফেলেছে, যার দুঃখে তাদের অনেকে এখন কুড়ে কুড়ে মরছে। তাদের সমাজবিদরা করছেন হাহাকার। সেসব দেশের অনেক নারী-পুরুষ এসব অনাচার দেখে আশ্রয় নিচ্ছেন ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে। এজন্য আবার ঘাবড়ে যাচ্ছে ওসব দেশের হর্তাকর্তারা। পশ্চিম যে এখন নোংরামির চূড়ান্ত সীমায় চলে এসেছে, তথাকথিত সমলিঙ্গের বিয়েকেও আইন করে বৈধতা দিচ্ছে তা তো আর একদিনে হয়নি। বরং প্রথম দিকে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও বেহায়াপনার সয়লাব ঘটিয়েছে। এরপর বেড়েছে তাদের মধ্যে অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা। যার কারণে বিবাহ বিচ্ছেদের হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। একসময় এটি নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে নারীপুরুষের বিবাহহীন অস্বাভাবিক জীবনযাপনকেই তারা বৈধ বানিয়ে ফেলেছে। যার ফলে হাজার হাজার সন্তান জন্ম নিচ্ছে পিতৃপরিচয়হীন।

বলার অপেক্ষা রাখে না, একটি বড় গুনাহ করার পর যদি তাওবা করা না হয় তাহলে সেটি তার চেয়ে আরও বড় গুনাহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।  এর কারণে এক সময় ব্যক্তির জীবন ও সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। বর্তমান পৃথিবীর তথাকথিত পশ্চিমা সভ্যজাতি ও তাদের অন্ধ অনুসারী অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে। অস্বাভাবিক বেহায়াপনা ও মনুষ্যত্ববোধ বৈশিষ্ট্যহীন জৈবিক জীবনের প্রচারক হয়ে উঠছে এখন তারা। এই যে সমলিঙ্গের বিবাহকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে এবং এগুলোকে মানবাধিকার আখ্যা দেওয়া হচ্ছে, কখনো এদেশে তাদের কিছু গোলাম সংবাদমাধ্যমগুলো সেগুলোর ইতিবাচক প্রচারও করছে। তা যদি হয় প্রকৃত অর্থে মানবতা ও মানবাধিকার তাহলে তো হাইওয়ানিয়্যাত তথা পশুত্বও লজ্জা পেয়ে যাবে। কারণ, পশুদের ওখানে বিবাহ-শাদির বালাই না থাকলেও এ স্তরে তারা কখনো গিয়েছে বলে শোনা যায়নি। তাই এখনো আমাদের সতর্ক হওয়ার সময় আছে। আমাদের ভাবতে হবে, মুসলিম সমাজে কেন এ অধঃপতন হচ্ছে।

ফিরে আসি ওই মহিলার কথায়। তিনি বলেছেন, তালাকের একটি বড় কারণ হচ্ছে, বেওয়াফায়ি তথা অবিশ^স্ততা। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, দুজন সাধারণ মানুষও যদি কেউ কারও প্রতি বেওয়াফায়ি বা অবিশ্বস্ততার পরিচয় দেয়, যদি বিশ্বস্ততা রক্ষা না করে তাহলে তাদের সুসম্পর্ক অব্যাহত থাকে না। সেক্ষেত্রে একজন জীবনসঙ্গী বা জীবনসঙ্গিনীর কেউ যদি অন্যের প্রতি অবিশ্বাসের আচরণ করে, বিশ্বস্ততা  বা আস্থা নষ্ট করে তাহলে সে সম্পর্ক টেকানো খুব কঠিনই হবে। ইসলাম কিন্তু স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই এ বিশ্বস্ততা ধরে রাখার জোর তাকিদ দিয়েছে। স্বামীদেরকে পরিষ্কার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে স্ত্রীদের অধিকারগুলো, তাদের যৌক্তিক প্রয়োজনগুলো যথাযথভাবে যথাসময়ে পূরণ করতে। অন্য দিকে স্ত্রীদেরকেও বলা হয়েছে, স্বামী ও তার ঘরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে। আর পুরুষদের সততা ও বিশ্বস্ততার জন্য তো রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের স্ত্রীদেরকে প্রমাণ হিসেবেই দাঁড় করিয়েছেন। এরশাদ করেছেন

خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لأَهْلِهِ.

তোমাদের পুরুষদের মধ্যে তারাই ভালো মানুষ বলে প্রমাণিত হবে যাদেরকে তাদের স্ত্রীগণ সৎ আখ্যা দেবে।জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৮৯৫

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান সময়ে স্বামীদের এবং কখনো কখনো স্ত্রীদের থেকে এ বিশ্বস্ততা হারিয়ে যাচ্ছে কেন? এখানে স্বামী-স্ত্রীর বন্ধনের আবদ্ধ হওয়া মানেই হলো, একে অপরের জন্য আস্থার প্রতীক হওয়া। সেখানে তাদের মধ্যেই কেন ঘটবে বিশ্বাসঘাতকতা। বর্তমান সময়ের স্বামী-স্ত্রীদের উদঘাটন করতে হবে সে কারণগুলো।

মহিলাটি তালাকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ বলেছেন, বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অবাধ ব্যবহারের কারণে বিবাহিত নারী-পুরুষদের অন্যের স্ত্রী বা স্বামীর প্রতি আসক্তি ও তাদেরকে পটানোর হার বেড়েছে গাণিতিক হারে। ৯০ এর দশকে এটা চিন্তাও করা যেত না যে, কোনো পুরুষের অন্য কোনো মেয়েকে ভালো লাগল এবং সে সহজে তার সঙ্গ বা সান্নিধ্য পেয়ে গেল। কিন্তু বর্তমানে ছেলেরা সহজেই নিজের ঘরের বাইরের অসংখ্য মেয়েদের পেয়ে যাচ্ছে। যে কারণে তাদের কাছে স্ত্রীদের আর কোনো মূল্য থাকছে না।

মহিলাটি আরও বলেন, আমি এমন অনেক মেয়েকে চিনি, যাদের অন্য বিবাহিত পুরুষের সাথে প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে। এগুলো দেখে আমার অনেক দুঃখ হয়। তিনি বলেছেন, অনেক পুরুষই মিথ্যা বলেন এবং গোপনে দ্বিতীয় বিবাহও করে নেন। কিছু মেয়ে এমনও রয়েছে যারা টাকা-পয়সাওয়ালা ছেলে দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে।

উপরের কথাগুলো যে চরম সত্য তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমরা মুসলমানেরা আজ এগুলোতে জড়িয়ে পড়েছি। অথচ আমাদের সৃষ্টিকর্তা মহান রাব্বুল আলামীন এবং নারীকুল ও মানবতার মুক্তিদাতা আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসব বিষয়ে আগেই সতর্ক করেছেন।

ভেবেছিলাম, আজকের লেখাটি এক পৃষ্ঠার হবে। এখন দেখছি, লম্বা হয়ে গেছে। আজ আর বাড়াতে চাই না। নাদিয়া খানের শেষ কাথাটি ছিল, বর্তমানে তালাকের হার বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ হচ্ছে, আর্থিকভাবে অনেক মহিলার স্বাবলম্বী হওয়া। অর্থাৎ অনেক মেয়ে ভাবে, আমার যেহেতু চাকরি-বাকরি বা টাকা-পয়সা আছে তো কেন একজন পুরুষের সাথে বিশ্বস্ত থাকতে হবে অথবা কেন অন্যের হস্তক্ষেপ বরদাশত করতে হবে?

উপরোক্ত মহিলার কথাগুলো আমি এজন্য উদ্ধৃতি করলাম কারণ বর্তমান সমাজের অনেকেই ওই জগৎকে আলোকোজ্জ্বল ও শান্তির মনে করে থাকে। অথচ এই কদিন আগেও ঢাকার একটি জাতীয় পত্রিকায় দেখলাম, একদিনে সে জগতের তিন জোড়ার বিচ্ছেদের খবর এসেছে। তো যারা ওসব জগতের লোকদের আদর্শ মনে করে তারা অন্তত নাদিয়ার মতো পোড় খাওয়া মহিলাদের অনুভূতি বিবেচনা করুক। এবং তার কথাগুলো মিলিয়ে দেখুক দাম্পত্য জীবনে ইসলামের কালজয়ী বিধানাবলির সাথে যেসব কারণ তিনি উল্লেখ করেছেন সেগুলোর প্রতিকার এবং সেগুলোতে না পড়ার জন্য রক্ষাকবচ ইসলামে আগে থেকেই দেওয়া আছে কি না। সুতরাং চলুন ফিরে যাই ইসলামের বিকল্পহীন শান্তিময় পারিবারিক ব্যবস্থায়।

رفعتوں کی جستجو میں ٹھوکریں تو کھا چکے + آستان یار پر اب سر جھکا کر دیکھئے

উন্নতির সন্ধানে অনেক ঠোকরই তুমি খেয়েছ,/বন্ধুর আস্তানায় এখন মাথা ঝুঁকিয়ে দেখ।

 

 

advertisement