জুমাদাল আখিরাহ ১৪৪৩   ||   ফেব্রুয়ারি -এপ্রিল ২০২২

সম্পাদকীয়

সকল প্রশংসা মহান রাব্বুল আলামীনের, যিনি নারীকে মাতৃত্বের অতুলনীয় মর্যাদায় ভূষিত করেছেন। তার হৃদয় কানায় কানায় ভরে দিয়েছেন অসীম মমতায়। সে মমতার উষ্ণতায় টিকে থাকে পরিবার, গড়ে ওঠে মুমিন-মুত্তাকী, সচেতন ও আদর্শ প্রজন্ম।

দরূদ ও সালাম হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি, যিনি জাহিলিয়াতের বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা থেকে উদ্ধার করেছেন নারী জাতিকে। বাবা হয়ে কন্যার হকের কথা, ভাই হয়ে বোনের হকের কথা, স্বামী হয়ে স্ত্রীর হকের কথা, নবী হয়ে উম্মতের নারীদের হকের কথা বলেছেন। নারীকে মর্যাদার এমন উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করেছেন যে, কন্যা-সন্তানের সুষ্ঠু লালন-পালনকে বাবার জান্নাতে যাওয়ার ওসিলা বানিয়েছেন। আর সন্তানের জান্নাতকে সরাসরি মায়ের পদসেবায় রেখেছেন।

সুবহানাল্লাহ! তিনি শুধু মুখে বলেই ক্ষান্ত হননি, বরং নিজের আমলী ও ব্যবহারিক জীবনের মাধ্যমে উম্মতকে হাতে-কলমে শিখিয়ে দিয়ে গেছেন। কন্যার প্রতি তাঁর ভালবাসা ছিল অতুলনীয়। তিনি বলেছেন, ফাতেমা আমার অংশ। যে তাকে কষ্ট দিল সে আমাকে কষ্ট দিল। দুধ বোনের প্রতি তাঁর আচরণ এতটাই বিনম্র ছিল যে, বোন শায়মাকে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানিয়েছেন, গায়ের চাদর খুলে বিছিয়ে দিয়েছেন, কাছে বসিয়েছেন এবং বিদায় বেলায় সসম্মানে এগিয়ে দিয়েছেন। স্বামী হিসেবেও ছিলেন উদার, সহনশীল, যা আজও আমাদেরকে মুগ্ধ ও আলোড়িত করে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে তাওফীক দান করুন তাঁর সুন্নাহ অনুসরণ করার।

সেই সাড়ে চৌদ্দ শ বছর আগে ইসলাম নারীকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিশা দিয়েছে। উদ্ধার করেছে জাহিলিয়াতের ঘোর অমানিশা থেকে। সর্বোচ্চ মূল্যায়ন করে তার কাঁধে ন্যস্ত করেছে সুমহান এক দায়িত্ব। প্রজন্ম গড়ার ও সমাজ বিনির্মাণের গুরু দায়িত্ব। তাই তো আল্লাহ তাআলা নারীকে পর্বতসম ধৈর্য ও গভীর মমতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। সেই ধৈর্য ও মমতা দিয়ে তিলে তিলে তারা গড়ে তুলেছেন আদর্শ পরিবার, আদর্শ সমাজ, আদর্শ জাতি।

ইতিহাসের প্রতিটি পাতা আমাদের বলে, ইসলামই একমাত্র ধর্ম, যা নারীকে তার প্রাপ্য পূর্ণ মর্যাদা দান করেছে। তার সব ধরনের হকের প্রতি যত্নবান হওয়ার জোরালো নির্দেশ দিয়েছে।

সেই নবীযুগ থেকেই নারীর জন্য ছিল আলাদা শিক্ষালয়। সেখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদের বিশেষভাবে তরবিয়ত করতেন। তাদের চিন্তা-চেতনার বিকাশ, জ্ঞান অর্জনসহ যাবতীয় বিষয়ই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গুরুত্বের সঙ্গে তত্ত্বাবধান করতেন।

তিনি ছিলেন সুমহান শিক্ষক, তাই ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই তিনি নারীদের শিক্ষার প্রতি ছিলেন অত্যন্ত যত্নবান। নারীদের জন্য আলাদা শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন; ইলমে দ্বীন হাসিলের ফরয দায়িত্বে পুরুষের পাশাপাশি নারীকেও শামিল করে নিয়েছেন। অথচ এক শ্রেণির মতলবী অথবা অবুঝ লোকেরা বলে, ইসলাম নাকি নারীশিক্ষার অন্তরায়। নারীদের অগ্রগতিতে বাধা। এছাড়া আরও কত রকমের মিথ্যাচার। এভাবে নিজেদের অতীত অপকর্মের দায় ইসলামের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে সাজতে চায় নারীবাদী নারীদরদি।

তারা জানে, মাতৃজাতিকে বিপথগামী করতে না পারলে মুসলিম উম্মাহ আবারো পেয়ে যেতে পারে সালাহুদ্দীনের মতো মহাবীর, পেয়ে যেতে পারে তারেক বিন যিয়াদের মতো আরও অসংখ্য মহান বীরপুরুষ, যাদের নাম শুনলে আজও কেঁপে ওঠে তাদের অন্তরাত্মা। তাই তারা উঠে পড়ে লেগেছে মুসলিম নারীদের আত্মপরিচয় ও দায়িত্ববোধ ভুলিয়ে দিতে। যেন মুসলিম নারীরা পশ্চিমা সংস্কৃতির নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে এবং মরীচিকার পেছনে ছুটে যেন ভুলে যায়- সালাহুদ্দীন, ইবনে যিয়াদ ও ইবনে কাসিম তাদেরই সন্তান।

মনটা ভীষণ দমে যায়, যখন মুসলিম নারীদের দেখি- ইলম, আমল, তাকওয়া, তাহারাত, আখলাক ও শিষ্টাচারে উৎকর্ষ সাধনের পরিবর্তে পশ্চিমা ভোগবাদী সংস্কৃতিতে গা ভাসিয়ে দিতে। ভোগবাদী সমাজ, পরিবেশ ও সংস্কৃতি তাকে নিজের ইলম, আমল ও আখলাকের দৈন্যের কথা ভুলিয়ে রেখেছে। পার্থিব জীবনের জৌলুস তাকে অপার্থিব জীবনের অনন্ত সুখের সাধনার পথ থেকে উদাসীন করে রেখেছে। সে ভুলে গিয়েছে সেই সব মহীয়সীদের, যারা নিঝুম রাতে আরামের ঘুম, আরামের বিছানা বাদ দিয়ে ইলম, আমল ও তাকওয়ার উৎকর্ষ সাধনে নিরন্তর ব্যস্ত থেকেছেন।

মুসলিম নারী তো তাকওয়া, তাহারাত ও আখলাকের মূর্ত প্রতীক। পার্থিব জৌলুসের মোহ তো তাকে মানায় না। দ্বীন-ধর্ম ও শিক্ষা-দীক্ষা বাদ দিয়ে শুধু সামান্য কদিনের পার্থিব জৌলুস নিয়ে ব্যস্ত থাকলে আদর্শ কন্যা ও ভগ্নি কীভাবে তৈরি হবে? আদর্শ কন্যা ও ভগ্নি তৈরি না হলে আদর্শ মায়ের প্রত্যাশা কি অবান্তর নয়? আদর্শ সমাজের জন্য আদর্শ মায়ের তো কোনো বিকল্প নেই। তাই আমাদের করণীয় হল, আগামীর মায়েদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা, দ্বীন-ঈমানের আলোয় আলোকিত করা। সেই করণীয় পালনে নিরন্তর চেষ্টা করে যাওয়া। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের তাওফীক দান করুন।

নারীসমাজের কাছে সালাফের মহীয়সী নারীদের ঈমান-আমল, শিক্ষা-দীক্ষা, সভ্যতা-ভদ্রতা ও আদব-আখলাকের স্মৃতি তাজা করে তুলতে উম্মাহর জ্ঞানী-গুণী ও আলেমসমাজ যুগ যুগ ধরে নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সেই চেষ্টারই অংশ হিসেবে মাসিক আলকাউসার কন্যা-জায়া-জননীদের জন্য আয়োজন করেছে ত্রৈমাসিক নারী। আশা করি, নারী মহলে আমাদের এ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা সাদরে গৃহীত হবে। সেই প্রত্যাশায় আজকের মতো বিদায় নিচ্ছি। মাআস সালামা।

 

টীকা :

০১। সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৭৬৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৪৪৯

০২। আল ইসাবা ফি তাময়িযিস সাহাবা ৭/৭৩২; আলওয়াফা বিআসমাইন নিসা ৫/৫৬৩

 

 

advertisement