আদর্শ সন্তান গঠনে সালাফের নারীদের অবদান
কিছু দিক কিছু দৃষ্টান্ত
মাতৃত্ব নারীজাতির গৌরব। এর কল্যাণে ও অবদানে নির্মিত হয় আদর্শ সমাজ, গঠিত হয় উত্তম জাতি। এর মাধ্যমে উম্মত পেয়েছে অসংখ্য আউলিয়া, ওলামা, মুজাহিদীন ও দ্বীনের শত কাণ্ডারি। তাই এ মাতৃত্ব আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বড় নিআমত ও প্রাপ্তি। এ জন্যই ইসলাম এ নিআমতকে, এ পদকে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছে। এ নিআমতের ধারককে যেমন করেছে সুউচ্চ মর্যাদায় সমাসীন, তেমনি তাঁকে দিয়েছে দায়িত্বের গুরুভার।
হাদীস শরীফের ইরশাদ—
كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ.. .. وَالمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلَى بَيْتِ زَوْجِهَا وَوَلَدِهِ.
তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, তোমারদের প্রত্যেকেই তার অধীনদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে।... নারী তার স্বামীর ঘর ও তার সন্তানের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। —সহীহ বুখারি, হাদীস ৫২০০।
সত্য কথা হলো, মা তো কত নারীই হয়, কিন্তু ‘আদর্শ মা’ হতে পারা অনেক মুজাহাদার বিষয়, আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত।
সে মুজাহাদার কিছু জীবন্ত ছবি এবং কুরবানীর কিছু নমুনা আমাদের দ্বীনের আদর্শ মহান সালাফে সালিহীন (নেককার পূর্বসূরীগণ)-এর জীবনপাতা থেকে উপস্থাপনের চেষ্টা করব, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা একে নাফে’ ও উপকারি বানান। আমীন।
জন্মের পূর্বেই দ্বীনের জন্য ‘ওয়াক্ফ’ করার প্রত্যয়
সালাফের নারীগণ সন্তান জন্মের পূর্ব থেকেই সন্তানকে আদর্শ সন্তান হিসেবে গড়ে তোলার ফিকির ও পরিকল্পনা করতেন। এর জন্য পূর্বপ্রস্তুতি নিতেন। কুরআন মাজীদে উম্মে মারয়াম রা. এর মহান মান্নতের ঘটনা এর সমুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মহান রবের দরবারে তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠাপূর্ণ ও হৃদয়নিংড়ানো আকুতি নিয়ে বললেন—
رَبِّ إِنِّي نَذَرْتُ لَكَ مَا فِي بَطْنِي مُحَرَّرًا فَتَقَبَّلْ مِنِّي إِنَّكَ أَنْتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ.
হে আমার রব, আমার গর্ভে যে সন্তান আছে, আমি আপনার জন্য তার ব্যাপারে মান্নত করলাম যে, তাকে মুক্ত রাখা হবে। অতএব আপনি আমার পক্ষ থেকে কবুল করুন। —সূরা আলে ইমরান, (৩) : ৩৫
অর্থাৎ দুনিয়ার সমস্ত ব্যস্ততা, ঝায়-ঝামেলা ও দায়দায়িত্ব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, আল্লাহর ইবাদত ও বাইতুল মাকদিসের সেবার জন্য ওয়াক্ফকৃত। আকাক্সক্ষার বিপরীতে যখন কন্যাসন্তান জন্মলাভ করে, তিনি নিরাশ হননি। আল্লাহর ওপর ভরসা করে মান্নত পূর্ণ করলেন এবং বললেন,
وَإِنِّي سَمَّيْتُهَا مَرْيَمَ وَإِنِّي أُعِيذُهَا بِكَ وَذُرِّيَّتَهَا مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ.
আমি তার নাম রাখলাম মারয়াম এবং তাকে ও তার বংশধরগণকে অভিশপ্ত শয়তান থেকে হেফাজতের জন্য তোমার আশ্রয়ে অর্পণ করলাম। —সূরা আলে ইমরান, (৩) : ৩৬
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মায়ের এ নিষ্ঠা ও কুরবানিকে কী সাদরে মূল্যায়ন করলেন!
فَتَقَبَّلَهَا رَبُّهَا بِقَبُولٍ حَسَنٍ وَأَنْبَتَهَا نَبَاتًا حَسَنًا وَكَفَّلَهَا زَكَرِيَّا.
সুতরাং তাঁর প্রতিপালক তাঁকে (মারয়ামকে) উত্তমভাবে কবুল করলেন এবং তাঁকে উৎকৃষ্ট পন্থায় প্রতিপালন করলেন। এবং তাঁকে যাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে সোপর্দ করলেন। —সূরা আলে ইমরান, (৩) : ৩৭
বলাবাহুল্য, এ কন্যাসন্তান মারিয়াম রা. ও তাঁর অস্তিত্বে সুপ্ত হযরত ঈসা আ. কত বরকতপূর্ণ ছিলেন। হযরত উম্মে মারয়াম রা. তাঁর এ ইখলাস ও কুরবানির মাধ্যমে মায়েদের জন্য রেখে গেলেন আল্লাহর ওপর ভরসা করে আল্লাহর তরে সন্তানকে ওয়াক্ফ করার উজ্জ্বল শিক্ষা। মাওলানা মানযূর নুমানী রাহ. বলেন, “ইমাম আবু বকর জাস্সাস রাযী রাহ. ‘আহকামুল কুরআন’ কিতাবে এ আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে লিখেছেন, সন্তানকে আল্লাহর জন্য ওয়াক্ফ করার এ ধারা শরীয়তে মুহাম্মাদীতেও বহাল রয়েছে, তবে শরীয়তে মুহাম্মাদীর স্বভাব ও প্রকৃতি অনুুযায়ী তার রূপ সংশোধন করা হয়েছে। অর্থাৎ যারা সন্তানকে আল্লাহর জন্য ওয়াক্ফ করতে চায়, তারা এভাবে নিয়ত করবে যে, এই সন্তানকে আমি আল্লাহর জন্য এবং তাঁর দ্বীনের খিদমতের জন্য ওয়াক্ফ করলাম। এতে সে ইলমে দ্বীন হাসিল করা এবং দ্বীনের খেদমত করার জন্য ওয়াক্ফ হয়ে যাবে। তবে আমাদের শরীয়তে মুহাম্মাদীতে এজন্য তার সংসার ত্যাগ করার প্রয়োজন নেই এবং অনুমতিও নেই। জীবনকে সে আল্লাহর নামে উৎসর্গ করবে, জীবনের অঙ্গনে অবস্থান করে। প্রয়োজনে সে উপার্জন ও জীবিকার পথ গ্রহণ করবে, বিবাহ-সংসার নির্বাহ করবে এবং সন্তান-সন্ততির তরবিয়ত করবে, এমনকি মা-বাবার সেবা-দায়িত্বও পালন করবে, কিন্তু তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হবে ইলমের তলব, দ্বীনের খেদমত এবং আল্লাহ তাআলার রিযা ও সন্তুষ্টি অর্জন। জীবনের অঙ্গনে অবস্থান করেও এ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পথেই হবে তার জীবন ও মরণ।” —তালিবানে ইলমের রাহে মনযিল পৃ. ২২-২৩
শৈশবেই ঈমানের বীজ বপন
শিশুর দ্বীনী মানসিকতা গঠনে মায়ের শিক্ষা ও তরবিয়তের তুলনা হয় না। শৈশব হল ভিত্তিস্থাপন ও বীজ বপনের বয়স। এ বয়সে মায়েরাই পারেন সন্তানের উর্বর হৃদয়ে এমন বীজ বপন করতে, যা আল্লাহ চাহে তো বিশাল, মজবুত ও ফলদায়ক বৃক্ষে পরিণত হতে পারে। সালাফের যুগে শিশুরা মায়ের সুশীতল পাঠশালা থেকেই পেতো ঈমান-তাওহীদের প্রাথমিক ধারণা। শিখত তাকওয়া, উত্তম আদাব-আখলাক ও ফরজে আইন ইলম। মায়ের কোল থেকেই সন্তানরা পেত ঈমানী চেতনা ও মর্যাদাবোধ, গুনাহ ও অন্যায়ের প্রতি ঘৃণার দীক্ষা। শৈশব থেকেই মায়েরা সন্তানকে ইবাদতে অভ্যস্ত করে তুলতেন।
হযরত উম্মে সুলাইম রা. যখন ইসলামের আলোয় আলোকিত হন, তখন তাঁর স্বামী মালিক বিন নাদর সফরে। মালিক ছিলেন মুশরিক। সফর থেকে ফেরার পর তিনি উম্মে সুলাইম রা.কে ধমক দিয়ে বললেন, তুমি ধর্মত্যাগী হয়ে গেছ?
উম্মে সুলাইম রা. উত্তর দিলেন, ‘আমি ধর্মত্যাগী হইনি, বরং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর ঈমান এনেছি।’
তাদের সংসারে আনাস নামক এক দুধের শিশু ছিল, যার সবে মুখ ফুটেছে। উম্মে সুলাইম রা. তাঁর এ সন্তানকেও আলোকিত করে গড়ে তোলার প্রত্যয় গ্রহণ করলেন। তাই এ বয়সেই তাকে শেখাতেন, বাবা, বলো, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। বলো, আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ।
শিশুটিও আধোআধোভাবে বলত। এভাবে উম্মে সুলাইম রা. তাঁর শিশু আনাসের অস্তিত্বে ঈমানের আভা ছড়াতেন। তার মুশরিক পিতা এসব দেখে রাগান্বিত হয়ে বলত, আমার ছেলেকে নষ্ট করছ কেন?
উম্মে সুলাইম রা. উত্তর দিতেন, আমি তাকে নষ্ট করছি না।
কিছুদিন পরেই মালিক মৃত্যুবরণ করলে উম্মে সুলাইম রা. এ শিশুর তরবিয়ত ও খেদমতের জন্য নিজেকে ওয়াক্ফ করার ওয়াদা করেন। বলেন—
لاَ جَرَمَ لاَ أَفْطِمُ أَنَسًا حَتَّى يَدَعَ الثَّدْيَ حَيًّا وَلاَ أَتَزَوَّجُ حَتَّى يَأْمُرَنِي أَنَسٌ. وفي رواية: حَتَّى يَبْلُغَ أَنَسٌ وَيَجْلِسَ فِي الْمَجَالِسِ.
আমি ওয়াদা করলাম, যতক্ষণ পর্যন্ত আনাস বেঁচে থেকে নিজেই দুধ না ছাড়বে, ততক্ষণ তার দুধ ছাড়াব না। আনাস বড় হয়ে যদি নিজেই আমাকে বিয়ে বসতে না বলে আমি বিয়েও বসব না।
উম্মে সুলাইম রা. ছিলেন বানূ নাজ্জার গোত্রের সম্ভ্রান্ত নারী। তাই দ্বিতীয় বিয়ের প্রস্তাব সহজেই পেতেন। কিন্তু এ সন্তানের জন্য তিনি ত্যাগ স্বীকারের সংকল্প করেন। মায়ের এ ত্যাগের কথা হযরত আনাস রা. স্মরণ করে বলতেন—
جَزَى اللهُ أُمِّي عَنِّي خَيْرًا لَقَدْ أَحْسَنَتْ وِلاَيَتِي.
আল্লাহ আমার মাকে উত্তম প্রতিদান দিন, তিনি আমার কত সুন্দর প্রতিপালন করেছেন। —তাবাকাতে ইবনে সা’দ ১০ : ৩৯৬
শতাব্দীর পর শতাব্দীজুড়ে উম্মতের মাঝে সমাদৃত এক মাযহাবের প্রণেতা ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইদরীস আশ্-শাফিয়ী রাহ. (২০৪ হি.)। তাঁর জন্ম হয় গাজা শহরে। তাঁর পিতা সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। মায়ের কোলই এ শিশুর একমাত্র আশ্রয়। কিন্তু এ শিশু তো কুরাইশ বংশের সন্তান। তাকে তো এ বংশের লাজ রাখতে হবে। এ বংশের আদর্শের ধারক হতে হবে। গাজার পরিবেশ এর অনুকূল নয়। তাই তার বয়স যখন দুই বছর মা তার বংশপরিচয় বিলীন হয়ে যাওয়ার আশংকায় তাকে নিয়ে কুরাইশের কেন্দ্র্রস্থল পবিত্র মক্কায় পাড়ি জমান। —সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১০ : ৬
লক্ষ্য করুন, যে বয়সে অনেক মা শিশুর দ্বীনী তরবিয়তের ফিকির করেন না, তখন থেকেই ইমাম শাফিয়ী রাহ. এর আম্মাজান এ দুধের শিশুর আদর্শ তরবিয়তের জন্য অনুকূল পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ফিলিস্তিন থেকে সুদূর মক্কায় পাড়ি জমিয়েছেন। মক্কায় স্বামীহারা এ নারীর জীবন ছিল অভাব-অনটনের। সংসারের খরচ নিজেই চালাতেন। তবুও এ দৈন্যদশা আদর্শ সন্তান গঠনে বাধা হতে পারেনি।
শৈশবে মায়ের দায়িত্ব, তার আদর্শ তরবিয়তের গুরুত্ব এবং সুদূরপ্রসারী প্রভাবকে মুফাককিরে ইসলাম হযরত আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. তাঁর মর্মস্পর্শী বক্তব্যে কত চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন! হযরত বলেন, ‘মায়েদের দায়িত্ব এটুকুতেই শেষ নয় যে, বাচ্চাকে আল্লাহ-রাসূলের নাম শিখিয়ে দেবে, সময় হলে নামায পড়া এমনকি কুরআন শরীফ পড়াও শিখিয়ে দেবে, মাতৃভাষাও রপ্ত করিয়ে দেবে..., এ গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর বাইরে তাদের এও জরুরি দায়িত্ব যে, তারা এ বাচ্চাদের কোমল অন্তরে কুফর-শিরকের প্রতি ঘৃণা তৈরি করবে। তাওহীদের সঙ্গে ভালোবাসা, এর ওপর গর্ববোধ এবং ইসলাম ও মুসলিম পরিচয়ে আনন্দ ও মর্যাদার অনুভূতি সঞ্চার করবে। দ্বীনের প্রতি গায়রত ও আত্মমর্যাদাবোধ, আল্লাহর আনুগত্য ও আখেরি পয়গম্বর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি হৃদয়নিংড়ানো ও মন উজাড় করা ভালোবাসা জাগরুক করবে। গুনাহের প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টি করবে। পার্থিব জৌলুসকেই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য এবং উন্নতি ও সফলতার মাপকাঠি ভাবা থেকে রক্ষা করবে। তার মাঝে ন্যায়পরায়নতা ও সত্যবাদিতার অভ্যাস গড়ে তুলবে। পরার্থপরতা, সৃষ্টিসেবা ও দেশপ্রেমের জযবা বদ্ধমূল করবে। এসব মায়েদেরই দায়িত্ব ও তাদেরই করার কাজ। এসব গুণ ও অনুভূতি যদি শৈশবে এবং ঘরের পরিবেশে জন্ম না নেয়, তাহলে পৃথিবীর বড় থেকে বড় জ্ঞানকেন্দ্র এবং সরকারি বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কোনো শিক্ষালয় এ কাজ করতে অক্ষম।’
হযরত আরও বলেন, ‘সত্য কথা হলো, হৃদয়ের মণিকোঠায়, মনের গহিনে ও অন্তরের উর্বর জমিতে সে শক্তিশালী বীজ মায়েরা এবং ঘরের পর্দানশীনরাই বপন করতে পারেন। এ বীজ যখন পরিণত হয়ে যায়, তখন কোনো মহাশক্তিই তা নির্মূল করতে পারে না। ইতিহাস এমন হাজারো দৃষ্টান্ত পেশ করেছে যে, মা-বোনদের থেকে পাওয়া শিক্ষা, তাদের শেখানো দ্বীন, তাদের জাগিয়ে দেয়া চেতনা ও অনুভূতি বড় বড় মুজাহিদের দৃঢ়তা ও অবিচলতার কারণ হয়েছে। আপনি যদি ভালোভাবে অনুসন্ধান ও তত্ত্বতালাশ করেন, তাহলে জানতে পারবেন, এ অবিচলতা ও জযবার গোড়ায় রয়েছে মায়েদের অবদান। এমন অনেক নজির আছে যে, বড় অনেক উলামায়ে ইসলাম গত হয়েছেন যাঁদের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল মায়েদের। মায়েরাই তাঁদেরকে জীবনের অন্তিম নিঃশ্বাস পর্যন্ত ইসলামের ওপর অবিচল থাকার শক্তি ও প্রেরণা জুগিয়েছেন। আপনি প্রায় প্রত্যেক মনীষীর জীবনপাতা উল্টে দেখুন, তাঁদের তরবিয়তে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল মায়েদের, বড়বোনদের, ঘরওয়ালিদের।’ —ইসলাম মেঁ আওরাত কা দারাজা পৃষ্ঠা : ২৩৬, ২৪০
এই প্রবন্ধে আমরা এমন কিছু মনীষীর জীবনে তাঁদের মায়েদের ভূমিকা পেশ করব, যাঁরা ছিলেন ইলম ও আমলে উম্মতের সমুজ্জ্বল নক্ষত্র।
ইলমের পথে সন্তানকে পেশ করা
ইমাম সুফিয়ান বিন সাঈদ ছাওরী রাহ. (১৬১হি.) ছিলেন হাদীস, ফিকহ, দুনিয়াবিমুখতা ও আল্লাহভীতিতে এ উম্মতের উজ্জ্বল নক্ষত্র। উম্মত তাঁকে হাদীস শাস্ত্রের আমীরুল মুমিনীন উপাধি দিয়েছে। তাঁর উজ্জ্বল জীবনে রয়েছে এক দরিদ্র অথচ আকাশসম হিম্মতের অধিকারী মায়ের অবদান। শৈশবেই আল্লাহ তাআলা ইমাম ছাওরী রাহ. এর অন্তরে ইলমের স্পৃহা ঢেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু সংসারে ছিল অভাব ও দারিদ্র্য। তাঁর নেককার মা বললেন—
يا بني، اطلب العلم وأنا أكفيك من مغزلي.
বাবা, তুমি ইলম তলব করে যাও, আমি সুতো কেটে তোমার খরচ বহন করব। —তারীখে জুরজান, পৃষ্ঠা : ৪৯২
সুবহানাল্লাহ! মা নিজেই সন্তানের খরচের দায়িত্ব নিয়ে তাঁর ইলম তলবের পথ সুগম করে দিলেন! মায়ের এ প্রেরণাদান ইমাম ছাওরী রাহ. এর উদ্দীপনায় তরঙ্গ সৃষ্টি করল। সকল অভাবের বাধ ভেঙ্গে তিনি ইলমের পথে এগিয়ে চলেন।
সে যুগে ইলম তলব আজকের মতো সহজসাধ্য ছিল না। ইলমের জন্য মাতৃভূমি ছেড়ে দূর-দূরান্তের যাত্রা করতে হত। চষে বেড়াতে হত একের পর এক ইলমের কেন্দ্র-শহরগুলো। যাত্রা ছিল বিপৎসংকুল ও কষ্টের। ইলমের জন্য ঘর থেকে বের হলে মাস দুমাস নয়, বহু বছর পর ফেরা হত। উপরন্তু ছিল না আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা। এ লম্বা সময়গুলো মায়েরা অত্যন্ত সবর ও কুরবানির সঙ্গে কাটাতেন। একটি দৃষ্টান্ত পেশ করছি।
ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী রাহ. (২৩৪ হি.) ছিলেন হাদীস শাস্ত্রের বড় কাণ্ডারি। তিনি বলেন, একবার আমি মাতৃভূমি বসরা থেকে ইলম অন্বেষণের উদ্দেশ্যে ইয়েমেনের পথে যাত্রা করলাম। তিন বছরের মতো বসরা থেকে দূরে ছিলাম। আমার মা তখন জীবিত ছিলেন। ফেরার পর মা আমাকে বললেন, বাবা, জেনে রেখো, অমুক তোমার বন্ধু, অমুক তোমার শত্রু।
আমি বললাম, মা আপনি কীভাবে জানলেন?
তিনি বললেন, তুমি যখন ইলমের সফরে ঘরের বাইরে ছিলে, তোমার জন্য আমার মন অনেক কাঁদত। তখন অমুক অমুক আমাকে এসে সালাম দিয়ে সান্ত্বনা দিত এবং বলত, সবর করুন, দেখবেন যেদিন আপনার সন্তান ফিরে আসবে সেদিন তাঁর অর্জন করা ইলম দেখে আল্লাহ আপনাকে খুশি করে দেবেন। তখন বুঝলাম এরা তোমার কল্যাণকামী বন্ধু। আর অমুক অমুক আমাকে এসে বলত, আপনি তাকে বারবার চিঠি লিখে ফিরে আসতে বলেন, যেন সে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। —সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১১ : ৪৯
আমল, আদাব ও আখলাকের প্রতি সজাগ দৃষ্টি
ইলম তখনই নাফে’ (উপকারি), ফলপ্রসূ ও পরিপূর্ণ সাব্যস্ত হয় যখন তার সঙ্গে যুক্ত হয় আমল, উত্তম আদাব ও আখলাক। সালাফের নারীগণ এ বিষয়েও ছিলেন যত্নবান।
ইমাম সুফিয়ান ছাওরী রাহ. এর আম্মাজান তাঁকে বলতেন—
يا بني، إذا كتبت عشرة أحاديث فانظر هل ترى في نفسك زيادة في مشيتك وحلمك ووقارك، فإن لم تر ذلك فاعلم أنه يضرك ولا ينفعك.
দেখো বাবা, যখন তুমি ১০টি হাদীস শিখবে, দেখবে যে তোমার চালচলন, সহনশীলতা ও গাম্ভীর্যে কোনো উন্নতি আসছে কিনা। যদি এমনটা অনুভব না করো তাহলে জেনে রেখো এ ইলমে তোমার কোনো লাভ নেই। —তারীখে জুরজান পৃষ্ঠা : ৪৯২
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল রাহ. (২৪১ হি.) গর্ভে থাকা অবস্থায়ই বাবাকে হারান। মায়ের ছায়াতলেই কাটে তাঁর অনাথ শৈশব। মায়ের তরবিয়তে তিনি শৈশবেই অনন্য হয়ে ওঠেন। আবু সিরাজ বলেন, আমি আর আহমাদ একসঙ্গে মক্তবে পড়তাম। পাড়ার মহিলারা —যারা লিখতে জানত না— উস্তাযজীর কাছে সংবাদ পাঠাতেন, আমাদের চিঠির উত্তর লিখে দেয়ার জন্য আহমাদকে পাঠিয়ে দিন। মহিলাদের কাছে গেলে আহমাদ তাদের দিকে চোখ তুলেও তাকাত না। আমার আব্বু তার চালচলন ও আদব দেখে মুগ্ধ হয়ে বলতেন, আমি আমার ছেলের তরবিয়তের পেছনে এত এত খরচ করি, ভালো ভালো শিক্ষক আনি, তবুও তারা সফল হচ্ছে না। অথচ দেখো, এ এতীম ছেলেটার চালচলন কত সুন্দর! — মানাকিবে আহমাদ রাহ., ইবনুল জাওযী, পৃ. ২৩
আল্লাহওয়ালাদের সোহবত গ্রহণ ও আদর্শ অনুসরণের তাগিদ
হযরত হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান রা. বলেন, একবার আমার মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, সর্বশেষ কবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সোহবত গ্রহণ করেছ?
আমি বললাম, এত এত দিন হয়ে গেল।
মা আমাকে কঠিন ধমক দিলেন এবং বকাঝকা করলেন। আমি বললাম, ঠিক আছে মা, আমাকে যেতে দিন। আমি অবশ্যই এখনি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট যাচ্ছি। গিয়ে তাঁর সঙ্গে মাগরিবের নামায আদায় করব এবং তাঁর থেকে আপনার ও আমার জন্য ইস্তিগফার নিয়েই ছাড়ব। —মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩৩২৯
হাদীস ও ফিকহের নক্ষত্র ইমাম মালিক রাহ. (২৭৯ হি.) বলেন,
كَانَتْ أُمِّي تُلْبِسُنِي الثِّيَابَ وَتَعُمِّمُنِي وَأَنَا صَبِيٌّ وَتُوَجِّهُنِي إِلَى رَبِيعَةَ بْنِ أَبِي عَبْدِ الرَّحْمَنِ وَتَقُولُ يَا بُنَيَّ ائْتِ مَجْلِسَ رَبِيعَةَ فَتَعَلَّمْ مِنْ سَمْتِهِ وَأَدَبِهِ قَبْلَ أَنْ تَتَعَلَّمَ مِنْ حَدِيثِه وفِقْهِه.
শৈশবে আমার মা আমাকে সুন্দর পোশাক ও পাগড়ি পরিয়ে ইমাম রবিয়াতুর রায় রাহ. এর দরসে পাঠাতেন এবং বলতেন, বাবা, ইমাম রবিয়ার মজলিসে যাও, তাঁর থেকে হাদীস ও ফিকহ অর্জন করার আগে তাঁর শিষ্টাচার ও আচরণ রপ্ত করো। —আততামহীদ ৩ : ৪
জিহাদ ও শাহাদাতের পথে সন্তানকে কুরবান করা
আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক মায়ের অন্তরে সন্তানের প্রতি অতুলনীয় ভালোবাসা ঢেলে দিয়েছেন। সালাফের নারীরাও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। বরং সন্তানকে ভালোবাসায় তাঁরা ছিলেন আদর্শ। তবে দ্বীন ও ই’লায়ে কালিমাতুল্লাহর স্বার্থ যখন সামনে আসত, তখন তা তাঁদের নিকট থাকত সকল প্রীতি ও বন্ধনের ঊর্ধ্বে। দ্বীনের ঝাণ্ডা উঁচু করার স্বার্থে কলিজার ধনকেও জিহাদের পথে এগিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না। শাহাদাতের সংবাদ এলে অতুলনীয় সবরের পরিচয় দিতেন এবং গর্ববোধ করতেন।
ইমাম শা’বী রাহ. বলেন, উহুদ যুদ্ধের দিন জনৈকা মহিলা তাঁর এক ছেলের হাতে তলোয়ার তুলে দিলেন। সে তলোয়ারের ভার বহন করতে পারল না। মা তলোয়ারটিকে রশি দিয়ে তার বাহুর সঙ্গে বেঁধে দিলেন। তাঁকে নিয়ে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে উপস্থিত হয়ে আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার এ বাচ্চাটা আপনার সঙ্গে জিহাদ করবে।
যুদ্ধের ময়দানে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বলতেন, ‘বাবা, এই যে এদিকে হামলা করো, এই যে ওদিকে হামলা করো।’
এক পর্যায়ে সে আহত হয়ে লুটিয়ে পড়ে। তাকে নবীজীর কাছে নিয়ে আসা হয়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে দেখে বলেন, ‘বাবা, তুমি কি ঘাবড়ে গেলে?’
সে বলল, না, ইয়া রাসূলাল্লাহ। —মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদীস ৩৭৯৩৭
বিশিষ্ট তাবেয়ী হযরত মুআযা আল আদাবিয়্যাহ রাহ. এর সন্তান শাহাদাত বরণ করলে মহিলারা তাঁকে সান্ত্বনা দিতে এলে তিনি তাদেরকে লক্ষ্য করে বলেন—
مَرْحَبًا إِنْ كُنْتُنَّ جِئْتُنَّ لِتَهْنِئَتِي فَمَرْحَبًا بِكُنَّ، وَإِنْ كُنْتُنَّ جِئْتُنَّ لِغَيْرِ ذَلِكَ فَارْجِعْنَ.
আপনারা আমাকে অভিনন্দন জানাতে এসে থাকলে আপনাদেরকে স্বাগতম। যদি অন্য কিছুর জন্য এসে থাকেন তাহলে দয়া করে ফিরে যান। —হিলয়াতুল আউলিয়া ২ : ২৩৯
সততা ও আমানতদারির দীক্ষা
হযরত আনাস রা. বলেন, আমি বাচ্চাদের সঙ্গে খেলছিলাম। এমন সময়ে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার কাছে এলেন। আমাদের সবাইকে সালাম দিলেন। আমাকে একটা প্রয়োজনে পাঠালেন। বাসায় আম্মুর কাছে যেতে দেরি হয়ে গেল। যখন আম্মুর কাছে ফিরলাম, আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, এত দেরি করলে কেন? এতক্ষণ কোথায় ছিলে?
আমি বললাম, নবীজী আমাকে একটা কাজে পাঠিয়েছেন।
জিজ্ঞেস করলেন, কী কাজে?
আমি বললাম, বলা যাবে না, এটা নবীজীর গোপন কথা।
বললেন, খবরদার, নবীজীর গোপন কথা কাউকে বলবে না। —সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৪৮২
হালাল রিযিকের প্রতি গুরুত্বারোপ
মুআযা আল আদাবিয়্যাহ রাহ. তাঁর দুধ-সন্তানকে বলতেন, দেখো, হারাম খেয়ে আমার দুধ কলুষিত করো না। তোমাকে দুধ পান করানোর সময় আমি খুব চেষ্টা করেছি হালাল ছাড়া কিছু না খেতে। তাই তুমিও চেষ্টা করো সামনে হালাল ছাড়া কিছু খাবে না। তাহলে মাওলার খেদমত ও তাঁর ফয়সালায় সন্তুষ্টির তাওফীক জুটবে। —তাবাকাতুস সুফিয়া, সুলামী, পৃষ্ঠা : ৪০৬
আল্লাহ তাআলা উম্মতের মায়েদেরকে ‘আদর্শ মা’ হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।