শাবান-শাওয়াল ১৪৪৪   ||   মার্চ-মে ২০২৩

এ যুগের অনেক বড় একটি ফেতনা হল মোবাইল
এটা একেবারে ব্যবহার না করতে পারলেই ভালো

বাংলাদেশ নূরানী তালীমুল কুরআন ওয়াক্ফ এস্টেটের সাবেক প্রধান প্রশিক্ষক মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেব রাহ.-এর মুহতারামা আহলিয়া

 

[বাংলাদেশের আকাশে অত্যন্ত উজ্জ্বল এক গ্রহ ছিলেন হযরত মাওলানা মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুযূর রাহ.। তাঁর স্বপ্ন ছিল, ৬৮ হাজার গ্রামে ৬৮ হাজার কুরআনী মক্তব প্রতিষ্ঠা করা। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তাঁর বেশ কয়েকজন শাগরেদ বাস্তবিক অর্থেই জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁদের অন্যতম ছিলেন হযরত মাওলানা কারী বেলায়েত হুসাইন রাহ. ও হযরত মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেব রাহ.। তাঁদের মাধ্যমেই এদেশে নূরানী পদ্ধতিতে কুরআন শিক্ষার মেহনত প্রতিষ্ঠা, বিস্তার ও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে।

হযরত মাওলানা কারী বেলায়েত ছাহেব রাহ. ইন্তেকাল করেছেন ১৪৩৮ হিজরীর ২৮ রমযান মোতাবেক ২৪ জুন ২০১৭ সালে। হযরত মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেব রাহ. ইন্তেকাল করেছেন ২৮ রমযান ১৪৩৯ হিজরী মোতাবেক ১৪ জুন ২০১৮ সালে।

প্রথমজনের স্ত্রী ইন্তেকাল করেছেন ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ সালে। তবে দ্বিতীয়জনের স্ত্রী এখনো হায়াতে আছেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে সিহহাত ও আফিয়াতের সাথে দীর্ঘ নেক হায়াত দান করুন আমীন।

এবার এই মহীয়সী নারীর সাক্ষাৎকার নিয়েই আমাদের আয়োজন। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন তাঁরই নাতনি জামাই মাওলানা মুহাম্মাদ তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব। সঙ্গে থাকার জন্য সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও দুআ রইল।ওয়ালিউল্লাহ আব্দুল জলীল]

 

তাওহীদ :   মাসিক আলকাউসারের পক্ষ থেকে এখন তিনমাস পরপর নারী নামে একটি পত্রিকা বের হয়। সেখানে মহীয়সী নারী এবং মনীষী ব্যক্তিদের স্ত্রীদের সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। আগামী সংখ্যার জন্য আমরা আপনার সাক্ষাৎকার নিতে চাই।

নানু :        আমার সাক্ষাৎকার নিয়ে কী হবে?

তাওহীদ :   আপনি তো হযরত মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেব রাহ.-এর স্ত্রী এবং হযরত মাওলানা কারী বেলায়েত ছাহেব রাহ.-এর ভাবী। যাঁদের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা ব্যাপক পরিসরে কুরআনের খেদমত নিয়েছেন, তাঁদের পরিবারেই কেটেছে আপনার দীর্ঘ জীবন। আপনার কাছ থেকে আমরা অনেক কিছু জানতে পারব এবং তা থেকে অনেক উপকৃত হব, ইনশাআল্লাহ।

নানু :        আল্লাহ তাআলা আমাদের সবার জীবনকে কবুল করুন। দুনিয়া ও আখিরাতে কামিয়াবী দান করুন।

তাওহীদ :   প্রথমে আপনার শৈশব, বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনার কিছু স্মৃতিগল্প শুনতে চাই।

নানু :        আমার বয়স এখন প্রায় ৭৫ বছর। আমাদের শৈশবের কথা মানে ৬০/৭০ বছর আগের কথা। সেসময় পুরো দেশের অবস্থাই অন্যরকম ছিল।

              আমার জন্ম হয়েছে গ্রামে। বর্তমান চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি থানার শিমুলিয়া গ্রামে। আমাদের বাড়িকে একসময় বলা হত, সবর আলী কারী ছাহেবের বাড়ি। পরে বলা হত, সিমাইল্যা (শিমুলিয়া) কারী ছাহেবের বাড়ি। সবর আলী কারী ছাহেব হলেন আমার দাদা। তিনি উজানীর কারী ইবরাহীম ছাহেব রাহ. এর খলীফা ছিলেন। বহু মানুষ তাঁর কাছে কুরআন শিখেছেন। আমার আব্বা হলেন কারী মাওলানা সফিউল্লাহ ছাহেব। তিনি বি. বাড়িয়ার জামিয়া ইউনুসিয়ায় পড়াতেন।

              আলহামদুলিল্লাহ, খুব সুন্দর দ্বীনী পরিবেশে আমরা বেড়ে উঠেছি।

              আমার পড়াশোনা শুরু হয়েছে আম্মার কাছে। আম্মা বাড়িতে মহিলাদেরকে পড়াতেন। আশপাশের বহু মানুষ তাঁর কাছে পড়তে আসত। আমিও তাদের সাথে পড়েছি। আম্মার কাছে কুরআন তিলাওয়াত শেখার পর উর্দু কিতাবাদিও পড়েছি। উর্দূ কায়দা, তালীমুল ইসলাম, বেহেশতী যেওর এসব কিতাব পড়েছি। এর মাঝে আব্বার কাছেও কিছু পড়েছি। বিভিন্ন সূরা মশক করেছি। আব্বার কণ্ঠ ভালো ছিল। গুন্নাহ করতেন অনেক সুন্দর করে। 

              সে সময় মেয়েদের পড়াশোনার তেমন ভালো ব্যবস্থা ছিল না। পুরো দেশের অবস্থাই তখন অন্যরকম ছিল। এখন সেকথা কল্পনাও করা যাবে না। অবশ্য প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার ব্যবস্থা না থাকলেও দ্বীনী চিন্তা ও দ্বীনী মানসিকতার পরিবেশ ছিল। ঘরে ঘরে নামায ও কুরআন তিলাওয়াতের পরিবেশ ছিল। প্রতিটা পরিবারের ছেলে-মেয়ে পর্দার পরিবেশেই বড় হতো। সহীহ আকীদা বিশ্বাস নিয়ে বড় হতো। অন্তত আমাদের পরিবার ও সমাজে আমি এমনই দেখেছি।

তাওহীদ :   আপনারা ভাইবোন কয়জন?

নানু :        আমরা দুই ভাই, চার বোন। এক ভাই মাওলানা আবদুল বাতেন ছাহেব হায়াতে আছেন। তিনি একজন বড় আলেম। আরেক ভাই আবদুল হাই। সে যুবক বয়সে, বিয়ের আগেই ইন্তেকাল করেছে। বোনদের মাঝে আমি ছাড়া বাকি সবাই আখিরাতের সফরে রওয়ানা হয়ে গেছে।

তাওহীদ :   হযরত মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেব রাহ.-এর সাথে আপনার বিয়ে হল কীভাবে, সেই গল্পটা শোনাবেন?

নানু :        আগের যামানায় তো মেয়েদেরকে অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দিত। সেই হিসেবে আমার বয়স যখন ১৪/১৫ বছর তখনই বিয়ের কথা শুরু হয়।

              কারী বেলায়েত ছাহেব রাহ.কে আমরা বলতাম বেলায়েত মালানা সাব। আল্লাহ তাআলা তাঁকে জান্নাত নসীব করুন। মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেব হলেন তাঁর আপন চাচাত ভাই। তাঁর স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস হলেন আমার সম্পর্কীয় ফুফাত বোন। এই বোনের মাধ্যমেই আমার বিয়ের কথা হয়।

              আমাদের এলাকায় একটি মাহফিল হতো। সেখানে উজানীর হুযূরগণ নিয়মিতই আসতেন। সেবারও এলেন। সেই মাহফিলেই উজানীর কারী (সম্ভবত কারী শরাফত করীম ছাহেব রাহ.)  বিয়ে পড়ান।

              বিয়ের পরদিন রুখসতি হয়। পালকিতে করে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়।

তাওহীদ :   হযরত মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেব রাহ. ও আপনার সংসার জীবন সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?

নানু :        তিনি তো ভালো মানুষ ছিলেন। সারাটা জীবন কুরআনের খেদমতে উৎসর্গ করে দিয়েছেন। সেজন্য সংসারের প্রতি খুব বেশি খেয়াল রাখার সুযোগ পাননি। তাই সংসারের বিষয়গুলো আমার শাশুড়ি আম্মাই দেখতেন। আমিও আমার শাশুড়ির সাথে থাকতাম। আমার শাশুড়ির ইন্তেকালের পর আমাকেই সবকিছু দেখতে হয়েছে।

              মানুষের আর্থিক অবস্থা সবসময় একরকম থাকে না। আমাদেরও ছিল না। একসময় অনেক কষ্টে দিন কাটত। তবে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে শোকর ও সবরের সাথে থাকার তাওফীক দান করেছেন। এখন আলহামদুলিল্লাহ কোনো কিছুর অভাব নেই। সব আল্লাহ তাআলার মেহেরবানি।

তাওহীদ :   আপনার শ্বশুর-শাশুড়ি সম্পর্কে কিছু বলবেন?

নানু :        শ্বশুরকে তো আমি পাইনি। তিনি রহমতুল্লাহ ছাহেবের ছোটবেলায়ই ইন্তেকাল করেছেন।

              শাশুড়িকে পেয়েছি অনেক বছর। তিনি ভালো মানুষ ছিলেন। তবে তার মেযাজ একটু কড়া ছিল। অবশ্য আগেকার শাশুড়িরা এমনিতেও মনে হয় একটু কড়া হতেন।

              তিনি কড়া যেমন ছিলেন তেমনি আদরও করতেন। তাঁর মনমতো থাকতে পারলে খুব আদর করতেন।

              তিনি রাগ হয়ে কিছু বললে সে কথার উত্তর না দিলে কিছুক্ষণ পরেই থেমে যেতেন। আসলে তাঁরাও অনেক কষ্টে বড় হয়েছেন তো। এজন্য অনেক কিছু খেয়াল করতেন। অনেক বিষয় হিসাব করতেন। বিভিন্ন জিনিস নিয়ে খুব ধরতেন।

              আমার ননাসও আমাকে খুব আদর করতেন। শাশুড়ি কোনো কড়া কথা বললে ননাস আমাকে সান্ত্বনা দিতেন। কখনো তার মাকেই বলতেন, আপনি শুধু শুধু ওকে ধমক দেন। ছোট ছোট বিষয় ধরে বসে থাকেন। (হাসি...)

তাওহীদ :   এমন পরিস্থিতিতে হযরত মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেব কী করতেন?

নানু :        তিনি আমাকে অনেক বোঝাতেন। শাশুড়ি কিছু বললে তিনি সান্ত্বনা দিতেন। বলতেন, আম্মাই তো বলেছেন। অন্য কেউ তো না। মুরুব্বিরা এমন একটু বলেনই। মন খারাপ করার দরকার নেই।

              আমি কিছু বললে বলতেন, লা হাউলা ওয়ালা কুওয়াতা পড়ো। শয়তান চলে যাবে। শয়তান মুরুব্বিদের সাথে তর্ক করতে শেখায়। ওয়াসওয়াসা দেয়। লা হাওলা পড়ো।

তাওহীদ :   এ বিষয়ে আপনি আপনার মেয়ে ও নাতনিদেরকে কী নসীহত করেন?

নানু :        আমি সবাইকে বলি, সংসার জীবন তো একদিনের না। অনেক দিনের। সব দিন এবং সব সময় মানুষের একরকম থাকে না। যেকোনো কষ্ট-মসিবতে ধৈর্য ধরতে হয়। ধৈর্য ধরলে আল্লাহ তাআলার কাছ থেকে অনেক বড় প্রতিদান পাওয়া যায়। সেই প্রতিদান কখনো নগদই পাওয়া যায়, কখনো এক দুই বছর পরে অথবা জীবনের শেষ সময়ে পাওয়া যায়। ধৈর্য কখনো বৃথা যায় না।

              আবার যার সংসারে শুধু সুখ আর সুখ, তারও নিশ্চিন্ত হওয়ার সুযোগ নেই। মানুষের সুখ-দুঃখ কোনোটাই স্থায়ী হয় না। তার উচিত আল্লাহ তাআলার খুব শুকরিয়া আদায় করা এবং সতর্কতার সাথে জীবন চলা।

              গাফেল মানুষদের জীবন কখনো ভালো হয় না।

তাওহীদ :   আপনার সন্তানদেরকে লালন-পালন করার বিষয়ে কিছু স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা শোনাবেন? সেইসাথে বর্তমানের মা-বাবাদের উদ্দেশ্যে কোনো নসীহত?

নানু :        আমরা তো আমাদের সন্তানদের জন্য তেমন কিছু করতে পারিনি। সুযোগ-সুবিধা খুব একটা ছিল না। তারপরও কুরআন শেখানো, নামায শেখানো, ইসলামী আকীদা শেখানোর চেষ্টা করেছি। আর শুধু দুআ করেছি। আল্লাহ তাআলা তাদের সবাইকে কবুল করেছেন।

              অন্যদেরকেও আমি বলি, বাচ্চাদেরকে ছোটবেলা থেকেই ইসলামী শিক্ষা দেওয়া, কুরআন শেখানো, নামায শেখানো, আকীদা শেখানো খুব জরুরি। ছোটবেলা থেকেই ইসলামী শিক্ষায় গড়ে তুললে সেটা বেশি মজবুত হয়। সহজেই ব্যতিক্রম পথে যায় না। আল্লাহ সবাইকে হেফাযত করুন।

              দ্বীনী শিক্ষা দেওয়া তো মা-বাবার অনেক বড় দায়িত্ব। এটা দায়িত্ব হিসেবে অনুভব করা উচিত এবং গুরুত্বের সাথে এই দায়িত্ব পালন করা উচিত। এতে আখেরাতের লাভ তো আছেই, দুনিয়াতেও অনেক লাভ। দ্বীনী শিক্ষা পেলে সন্তানরা মা-বাবার প্রতি খুব শ্রদ্ধাশীল হয়। আল্লাহর ভয় ও ভালবাসা মনের মধ্যে জায়গা পেয়ে যায়। তাতে সকল অন্যায় থেকে মানুষ বেঁচে থাকতে চেষ্টা করে এবং ভালো কাজের দিকে খুব অগ্রসর হয়।

              মেয়েদের ব্যাপারে বলব, অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পর্দার পরিবেশে গড়ে তুলতে হবে। পর্দাকে আনন্দের এবং সম্মানের বিষয় মনে করতে হবে। পর্দার বিধান যে আল্লাহ তাআলার কত বড় নিআমত এটা বড় হলে মেয়েরা বুঝবে, ইনশাআল্লাহ।

তাওহীদ :   মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেবের কাছে তো বহু মানুষ কুরআন শিখেছে এবং নূরানী পদ্ধতির বহু শিক্ষক তৈরি হয়েছে। এক্ষেত্রে আপনি কি তাঁকে কোনো সহযোগিতা করতে পেরেছেন?

নানু :        (হাসি...) আমি আর কী সহযোগিতা করব? আমি ঘরে ছিলাম, দুআ করেছি, ব্যস। তবে এই খেদমতের জন্য অনেক মেহনত করার কারণে পরিবারে খুব বেশি সময় দিতে পারেননি, সেটাকে আমি খুশিমনে গ্রহণ করেছি এবং এর মাধ্যমে আমিও একটু হয়ত শরিক হয়েছি-আল্লাহ যদি কবুল করেন।

              তিনি কিশোরগঞ্জে যখন মাদরাসা করলেন তার প্রায় ১৫ বছর পর আমাকেও এখানে নিয়ে এলেন। চাঁদপুর থেকে কিশোরগঞ্জ অনেক দূরের পথ। অপরিচিত এলাকা। এখানে আসার পর দেখলাম, এই এলাকার মহিলারা নামায-কুরআন তেমন কিছুই পারে না। তখন তাঁর অনুমতি নিয়ে আমিই তাদেরকে পড়াতে শুরু করলাম। আমি তো নূরানী পদ্ধতির নিয়ম-তরিকা ভালোভাবে জানতাম না। তাই তিনিই আমাকে এগুলো ধরিয়ে দিয়েছেন। আর আমার বড় ছেলে আবুল কাশেম, সেও আমাকে পড়িয়েছে। অনেক বিষয় ধরে ধরে শিখিয়েছে। হাতের লেখাও আমি আমার বড়ছেলের কাছে শিখেছি।

              আমি যখন পাশের ঘরে পড়াতাম, হযরত মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেব আমার পড়ানো শুনতেন। কোনো ভুল করলে এ্যা...ই বলে আওয়াজ দিতেন। সঙ্গে সঙ্গে আমি তাঁর কাছে চলে যেতাম। তিনি আমার ভুল শোধরে দিতেন। বলতেন, এখানে আরেকটু টান হবে, আরেকটু খাটো হবে, আরেকটু গুন্নাহ হবে ইত্যাদি।

              এই এলাকার বহু মহিলাকে আলিফ-বা থেকে কুরআন শরীফ পর্যন্ত পড়ানোর তাওফীক হয়েছে। বিবাহিত-অবিবাহিত সব ধরনের ছাত্রীকেই পড়িয়েছি।

তাওহীদ :   সেই ছাত্রীরা কি এখনো আপনার সাথে যোগাযোগ রাখে?

নানু :        অনেকেই রাখে। অনেকে রাখতে পারে না। কারো দূরে বিয়ে হয়েছে। কারো সংসারের ব্যস্ততা অনেক বেড়ে গেছে। তারপরও মাঝেমধ্যে আসে। ফোন করে। বিভিন্ন জিনিস হাদিয়া দিতে চায়। খুব মহব্বত করে।

তাওহীদ :   এখন আপনার দিনগুলো কীভাবে কাটে?

নানু :        এই তো, ছোট ছেলে মাওলানা আবুল বাশারের সাথে থাকি। তার বউই সংসারের সব কাজ করে। আমার তেমন কিছু করতে হয় না। তবে শরীরও এখন আর তেমন ভালো থাকে না।

তাওহীদ :   আপনি কী কী আমল ও ইবাদত করেন? আপনার নাতি-নাতনিরা যেন আপনার থেকে শিখতে পারে এবং উৎসাহ লাভ করে, এ উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?

নানু :        তেমন কিছুই করতে পারি না। দুআ চাই আল্লাহ তাআলা যেন অনেক বেশি আমল ও ইবাদতের তাওফীক দান করেন। নিজের অবহেলা ও ত্রুটিগুলো ক্ষমা করে দেন। ঈমানের সাথে যেন মৃত্যু নসীব করেন এবং আমাদের সবাইকে যেন জান্নাতে ঠাঁই দেন।

              এমনিতে এখন তো বয়সও হয়েছে। শারীরিক দুর্বলতা এবং বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতাও আছে। এরমধ্যে যেটুকু আমল-ইবাদতের তাওফীক হয় তার জন্য আল্লাহ তাআলার অনেক শোকর আদায় করি। কিন্তু তা থেকে উৎসাহ পাওয়ার তেমন কিছু নেই।

              আমি বলি, পাঁচ ওয়াক্ত নামায আমাদের খুব গুরুত্বের সাথে পড়া উচিত। নামাযের ওয়াক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নামায আদায় করে নেওয়া উচিত। বিলম্বে আদায়ের অভ্যাস করা ভালো না।

              বিশেষকরে নফল নামাযগুলোর ব্যাপারে যত্নবান হওয়া উচিত। তাহাজ্জুদ, ইশরাক, চাশত, যাওয়াল ও আওয়াবীন ইত্যাদি নিয়মিত পড়তে পারলে ভালো। সম্ভব না হলে যেদিন সুযোগ হয় পড়া উচিত। এছাড়াও প্রতিদিন অন্তত দুই রাকাত সালাতুল হাজত ও সালাতুত তাওবা পড়া উচিত।

              প্রত্যেক নামাযের পর ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ, ৩৪ বার আল্লাহু আকবার পড়া উচিত। সকাল-সন্ধ্যা ছয় তাসবীহ পড়তে পারলে ভালো। এগুলোতে খুব বেশি সময় লাগে না। পাঁচ সাত মিনিটেই পড়া যায়।

              প্রতিদিন কিছু সময় কুরআন তিলাওয়াত করা। মুনাজাতে মাকবূল পড়া। এগুলো আবশ্যক করে নেওয়া উচিত। বুযুর্গানে কেরামও তো এগুলো পড়তে বলেন।

              এছাড়া কাজের ফাঁকে ফাঁকে ইসতিগফার, দরূদ শরীফ ও বিভিন্ন তাসবীহ পড়ার অভ্যাস করা উচিত। সবসময় যবানে যিকির জারি রাখা উচিত।

তাওহীদ :   নানাজি মাওলানা রহমতুল্লাহ ছাহেব রাহ.-এর আমল ও ইবাদত সম্পর্কে কিছু বলবেন?

নানু :        তিনি খুব আমলী মানুষ ছিলেন। নামায মুনাজাত ও যিকির তিলাওয়াতের প্রতি খুব যত্নশীল ছিলেন। নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়তেন। তাহাজ্জুদের পর দীর্ঘক্ষণ যিকির করতেন। তার যিকিরের আওয়াযেই সাধারণত আমাদের ঘুম ভাঙত। আমার নাতি-নাতনিরাও তার শেষরাতের যিকিরের বিষয়ে অনেক স্মৃতিচারণ করে। তারাও সেই যিকির শুনত। তাদের কাছেও হয়ত ভালো লাগত।

তাওহীদ :   আপনার নাতি-নাতনি ও আলাকাউসারের পাঠক-পাঠিকাদের উদ্দেশ্যে কিছু নসীহত করবেন?

নানু :        আমি আর কী নসীহত করব? আমি আমার ছাত্রীদেরকে সবসময় বলি, অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পর্দার বিধান মেনে চলবে। পর্দা নারীদের সৌন্দর্য, মর্যাদা এবং আল্লাহ তাআলার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিধান।

              ফরয ইবাদতগুলোর সাথে বেশি বেশি নফল ইবাদতের চেষ্টা করবে। বিয়ের পর স্বামীকে খুব সম্মান করবে। স্বামীর কথামতো চলবে। শ্বশুর-শাশুড়িকে নিজের মা-বাবার মতো মনে করবে। তাদের খুব সেবাযত্ন করবে।

              সাংসারিক জীবনে শোকর ও সবর এই দুটি গুণ অর্জনের খুব চেষ্টা করবে। তাহলে জীবনে কোনো কষ্ট হবে না। আল্লাহ তাআলা খুব খুশি হবেন এবং অনেক নিআমত দান করবেন।

              আরেকটা বিষয় হলো, এ যুগের অনেক বড় একটি ফেতনা হল মোবাইল। এটা একেবারে ব্যবহার না করতে পারলেই ভালো। একান্ত যদি ব্যবহার করতেই হয়, বাটন মোবাইল ব্যবহার করবে। ইন্টারনেটওয়ালা মোবাইল থেকে খুব দূরে থাকবে।

              আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সব ধরনের ক্ষতি থেকে হেফাযত করুন। সব ধরনের কল্যাণ দান করুন। আমীন।

তাওহীদ :   আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য অনেক শুকরিয়া জানাচ্ছি। জাযাকিল্লাহু খাইরান।

নানু :        ওয়া ইয়্যাকুম।

 

 

advertisement