গর্ভাবস্থা ও রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা
মানুষের শরীরে বয়ে চলেছে লাল রক্ত। এই রক্ত আল্লাহপাকের কুদরতের এক অপূর্ব নিদর্শন। শ্বাস-প্রশ্বাস আমাদের জীবন। কিন্তু নিঃশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা সেই অক্সিজেন দেহের কোষে কোষে পৌঁছে যায় রক্তের মাধ্যমে। শরীরের ভেতরে বয়ে চলা এক একটা রক্তনালি যেন এক একটা নদী। নদী যেমন বয়ে চলার মাধ্যমে দুই পাশকে সবুজ-শ্যামল রাখে, তেমনই রক্তনালিগুলো অবিরাম রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে শরীরকে রাখছে সজীব-সতেজ। সেই রক্তে দ্রবীভূত হয়ে শরীরের নানা কোষে পৌঁছে যাচ্ছে অক্সিজেন। শুধু কি অক্সিজেন? পরিপাককৃত খাদ্য থেকে উৎপন্ন গ্লুকোজ, অ্যামাইনো এসিড, চর্বিকণা, নানা মিনারেলস ও ভিটামিনের বাহকও রক্ত। শরীরের ভেতর থেকে নিঃসৃত নানা হরমোন রক্তের মধ্য দিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে শরীরের নানা প্রান্তে। হরমোনগুলো বহন করে নিয়ে যাচ্ছে নানা নির্দেশনা। নার্ভাস সিস্টেমের অতিরিক্ত এটি শরীরের ভিন্ন ধরনের কন্ট্রোল সিস্টেম।
আমরা বলছিলাম রক্তের কথা। রক্তের সাথে মিশ্রিত হয়ে শরীরে ছড়িয়ে পড়া অক্সিজেনের কথা। কিন্তু সেই অক্সিজেন কীভাবে মিশ্রিত হয়ে যাচ্ছে? কে তাকে বয়ে নিয়ে চলেছে? এই কাজটির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এক ধরনের রঞ্জক। এর নাম হিমোগ্লোবিন। হিমোগ্লোবিন আমাদের শরীরের একটি প্রয়োজনীয় প্রোটিন। মেডিকেল সায়েন্সের ভাষায় যাকে বলা হয়, মেটালোপ্রোটিন। এটি আমাদের রক্তের লোহিত কণিকায় থাকে এবং রক্তের মাঝে প্রয়োজনীয় ঘনত্ব বজায় রাখে। হিমোগ্লোবিনের জন্যে রক্ত যেমন ঘন হয়, তেমনি লালও হয়। রক্তের অন্যান্য উপাদান সচরাচর বর্ণহীন হয়ে থাকে, হিমোগ্লোবিনই রক্তকে লাল করে থাকে।
হিমোগ্লোবিন বর্ণহীন রক্তকে লাল করার সাথে সাথে রক্তে থাকা নানা রকম উপাদানের পর্যাপ্ততাও নিশ্চিত করে থাকে। তবে হিমোগ্লোবিনের মূল কাজ শরীরে অক্সিজেন পরিবহন করা। এটি মানুষের শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পৌঁছে দেয়। রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে গেলে যেসব সমস্যা হয় তার মাঝে প্রধানতম বিষয়টি হচ্ছে অক্সিজেনের স্বল্পতা।
আমরা যখন বাতাস থেকে নিঃশ্বাসের সঙ্গে অক্সিজেন গ্রহণ করি, তখন এটি প্রথমে আমাদের ফুসফুসে যায়। আর ফুসফুস থেকে এই অক্সিজেন শরীরের প্রতিটি টিস্যুতে, প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গে পরিবহনের দায়িত্বটি পালন করে হিমোগ্লোবিন।
শুধু তাই নয়, এই হিমোগ্লোবিনের মাধ্যমেই অক্সিজেনের সাথে কার্বন ডাই-অক্সাইডের বিনিময় সম্পন্ন হয়। অর্থাৎ ফুসফুস থেকে অক্সিজেন হিমোগ্লোবিনের সাথে বাইন্ড হয়ে শরীরের কোষে কোষে পৌঁছে। আবার শরীরের নানা কোষে উৎপন্ন বিষাক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড হিমোগ্লোবিনের সাথে বাইন্ড হয়ে ফুসফুসে পৌঁছে। অতঃপর ফুসফুস থেকে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে তা শরীরের বাইরে বাতাসে চলে যায়।
উপরের আলোচনা থেকে বোঝা গেল, আমাদের রক্তের অক্সিজেন সরবরাহের সঙ্গে হিমোগ্লোবিনের সম্পর্ক কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই রক্তে যদি কখনো হিমোগ্লোবিন কমে যায়, শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়। তখন আমরা নানা রকম শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হই।
রক্তে কোনো দূষিত পদার্থ দেখা দিলে হিমোগ্লোবিন সেটাকে পরিষ্কার করে অর্থাৎ রক্তে যেকোনো ধরনের ক্ষতিকর পদার্থ মিশ্রণে বাধা প্রদান করে। এমনকি, আমাদের শরীরে যত ধরণের বিষাক্ত গ্যাস জমা হয়, হিমোগ্লোবিন সেগুলোকে শরীরের বাইরে পরিবহনেও সহযোগিতা করে থাকে।
মানুষের দেহের রক্ত কণিকার ৯৬ থেকে ৯৭ ভাগই হয়ে থাকে হিমোগ্লোবিনের প্রোটিন অংশ। আর রক্তের মোট ওজনের (পানিসহ) ৩৫ ভাগই দখল করে থাকে এই হিমোগ্লোবিন। আমাদের শরীরে থাকা প্রতি ১ গ্রাম হিমোগ্লোবিন বাতাস থেকে প্রতিবার ১.৩৬ মিলিলিটার, কখনো কখনো তার চেয়ে কিছুটা বেশি অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে। যার ফলে, শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ, বিশেষ করে রক্তে এর পরিবহনের মাত্রা প্রায় ৭০ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।
আমাদের শরীরের ৯৭ ভাগ অক্সিজেন ফুসফুস থেকে হিমোগ্লোবিনের মাধ্যমে শরীরের নানা অংশে সরবরাহ হয়ে থাকে। যে ৩ ভাগ বাকি থাকে, তা রক্তের প্লাজমায় মিশে যায়। হিমোগ্লোবিন রক্তের মধ্যে কমপক্ষে ৩০ থেকে ঊর্ধ্বে ১০০ বার পর্যন্ত অক্সিজেন মুভ করাতে পারে।
ফুসফুসের যেখানে অক্সিজেনের লেবেল অত্যন্ত বেশি থাকে, হিমোগ্লোবিনের মাধ্যমে খুব সুন্দরভাবে সেখানে অক্সিজেনের মাত্রা ব্যালেন্স হয়। অর্থাৎ যেখানে অক্সিজেন বেশি সেখান থেকে বাড়তি অক্সিজেন নিয়ে যেখানে কম সেখানে পৌঁছে দেয়। হিমোগ্লোবিনের প্রতিটি অণুর ৪টি আয়রন পরমাণু থাকে। আর প্রতিটি আয়রন পরমাণু একটি করে অক্সিজেন গ্রহণ করে।
আমাদের আজকের আলোচনা গর্ভাবস্থা ও রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রার সম্পর্ক নিয়ে। এই হিমোগ্লোবিনের স্বল্পতা শরীরে সৃষ্টি করে অ্যানিমিয়া।
অ্যানিমিয়া বলা হয়, যখন শরীরে অক্সিজেন বহন করার জন্য পর্যাপ্ত লোহিত রক্তকণিকা থাকে না। যখন শরীর রক্ত থেকে পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না, তখন কোষে কোষে গ্লুকোজ থেকে শক্তি উৎপাদন ব্যাহত হয়।
রক্তের যে কণিকায় হিমোগ্লোবিন থাকে তাকে বলা হয় লোহিত রক্তকণিকা বা RBC । লোহিত রক্তকণিকা ও হিমোগ্লোবিন তৈরি করতে শরীরে আয়রন এবং ভিটামিনের ধারাবাহিক সরবরাহ জরুরি। আয়রন ও ভিটামিনের এই সরবরাহ না থাকলে বা প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত হলে শরীর অঙ্গগুলিতে সঠিকভাবে অক্সিজেন বহন করার জন্য যথেষ্ট হিমোগ্লোবিন তৈরি করতে পারে না। এই অবস্থাটিকেই বলা হয় অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা।
অ্যানিমিয়ার ৪০০-এর অধিক টাইপ আছে। মহিলাদের গর্ভাবস্থায় অ্যানিমিয়া সাধারণত ঘাটতিজনিত কারণে সৃষ্টি হয়। ঘাটতিজনিত অ্যানিমিয়া কখনো খাদ্যে ঘাটতির কারণে হয়, কখনো চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে হয়। গর্ভাবস্থায় অ্যানিমিয়া সাধারণত নিম্নলিখিত প্রকারের হয়ে থাকে :
১. আয়রন ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতা (আয়রনের অভাবের কারণে)।
২. ফোলেট ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতা (ফলিক অ্যাসিডের অভাবের কারণে)।
৩. ভিটামিন বি-১২ এর ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতা (ভিটামিন বি-১২ এর অভাবের কারণে)।
গর্ভাবস্থায় কাদের অ্যানিমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি?
গর্ভাবস্থায় শরীরে রক্তের পরিমাণ ২০% থেকে ৩০% পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। এই বাড়তি লোহিত রক্তকণিকা গঠিত হওয়ার জন্য আয়রনের চাহিদা বেড়ে যায়। খাদ্যে যদি আগে থেকেই ঘাটতি থাকে কিংবা চাহিদা বৃদ্ধির কারণে বাড়তি আয়রন যদি না নেয়া হয়, অ্যানিমিয়া দেখা দেয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। নিম্নলিখিত অবস্থায় আয়রন ঘাটতির সম্ভাবনা বেশি থাকে :
১. টুইন প্রেগন্যান্সি (গর্ভাবস্থায় যমজ বাচ্চা)।
২. আয়রন সমৃদ্ধ খাবার না খাওয়া।
৩. দুই প্রেগন্যান্সির মাঝে গ্যাপ কম হওয়া।
৪. গর্ভাবস্থার আগে ভারী মাসিক প্রবাহের সম্মুখীন হওয়া।
৫. মর্নিং সিকনেসের কারণে প্রায়ই বমি হওয়া।
৬. একজন গর্ভবতী কিশোরী।
৭. গর্ভধারণের আগে থেকেই অ্যানিমিয়া থাকা।
এমনিতেও গর্ভাবস্থায় হালকা মাত্রার রক্তস্বল্পতা স্বাভাবিক। কারণ উন্নয়নশীল দেশগুলিতে প্রায় ৫২% মহিলা গর্ভাবস্থায় পর্যাপ্ত আয়রন পান না। তবে গুরুতর রক্তস্বল্পতা সাধারণত স্বাভাবিক নয়।
ফোলেট ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতা
ফোলেট হল, ভিটামিন যা কিছু খাবারে প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া যায়। যেমন : সবুজ শাকসবজি। এটি এক ধরনের বি ভিটামিন, স্বাস্থ্যকর লোহিত রক্তকণিকাসহ নতুন কোষ তৈরির জন্য শরীরে ফোলেট প্রয়োজন।
গর্ভাবস্থায় মহিলাদের অতিরিক্ত ফোলেটের প্রয়োজন হয়। কিন্তু কখনো কখনো তারা তাদের খাদ্য থেকে যথেষ্ট পান না। যখন এটি ঘটে, শরীর সারা শরীর জুড়ে টিস্যুতে অক্সিজেন পরিবহনের জন্য পর্যাপ্ত স্বাভাবিক লাল রক্ত কোষ তৈরি করতে পারে না। মানুষের তৈরি ফোলেটের পরিপূরককে ফলিক অ্যাসিড বলা হয়।
ফোলেটের ঘাটতি নির্দিষ্ট ধরনের জন্মগত ত্রুটিতে সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন : নিউরাল টিউব অস্বাভাবিকতা (স্পিনা বিফিডা) এবং কম জন্ম ওজন।
ভিটামিন বি-১২ এর অভাবজনিত রক্তস্বল্পতা
সুস্থ লোহিত রক্তকণিকা গঠনের জন্য শরীরের ভিটামিন বি-১২ প্রয়োজন। যখন একজন গর্ভবতী মহিলা তাদের খাদ্য থেকে পর্যাপ্ত ভিটামিন বি-১২ পান না, তখন তাদের শরীর পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যকর লোহিত রক্তকণিকা তৈরি করতে পারে না। যে মহিলারা মাংস, হাঁস-মুরগি, দুগ্ধজাত দ্রব্য এবং ডিম খান না তাদের ভিটামিন বি-১২ এর ঘাটতি হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে, যা জন্মগত ত্রুটি যেমন : নিউরাল টিউব অস্বাভাবিকতায় ভূমিকা রাখতে পারে এবং অকাল প্রসবের কারণ হতে পারে।
রক্তস্বল্পতা কখনো মাইল্ড বা হালকা হয়, কখনও সিভিয়ার বা গুরুতর হয়। তবে মাইল্ড বা সিভিয়ার (হালকা এবং গুরুতর) উভয় ধরনের অ্যানিমিয়ার ক্ষেত্রে মা ও ভ্রম্নণের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য চিকিৎসা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বিকাশমান ভ্রূণ যথেষ্ট আয়রন, ভিটামিন বি-১২ এবং ফলিক অ্যাসিড পাওয়ার জন্য মায়ের উপর নির্ভরশীল। অ্যানিমিয়া ভ্রূণের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করতে পারে, বিশেষ করে গর্ভাবস্থার প্রথম তিনমাসে। যদি অ্যানিমিয়ার চিকিৎসা না করা হয়, শিশুর জন্মের পরে রক্তস্বল্পতা হওয়ার ঝুঁকি থাকে, ফলে শিশু ঠিকমতো বেড়ে উঠে না। এছাড়াও অ্যানিমিয়ার কারণে গর্ভাবস্থা পূর্ণ হওয়ার আগেই শিশুর ডেলিভারি হয়ে যাওয়া (প্রি টার্ম লেবার) এর ঝুঁকি থাকে। সাথে সাথে কম ওজনের বাচ্চা (লো বার্থ ওয়েট বেবি) হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
গর্ভাবস্থায় অ্যানিমিয়া যদিও সরাসরি গর্ভপাত ঘটায় না, তবে গুরুতর রক্তস্বল্পতা গর্ভাবস্থার নানা জটিলতার কারণ হতে পারে।
রক্তস্বল্পতার অন্যান্য কারণ যা গর্ভাবস্থা ছাড়াও অন্যদের হতে দেখা যায়, তাও গর্ভাবস্থায় রক্তস্বল্পতার কারণ হতে পারে। যেমন : সিকেল সেল অ্যানিমিয়া এবং থ্যালাসেমিয়াসহ কিছু রোগ, ভারী মাসিক প্রবাহ (গর্ভাবস্থার আগে), পেপটিক আলসার, পলিপ, পাইলসের সমস্যা ইত্যাদি।
গর্ভাবস্থায় রক্তস্বল্পতার লক্ষণ
হালকা রক্তস্বল্পতায় প্রথমে কোনো উপসর্গ বা লক্ষণ নাও থাকতে পারে। তবে সময়ের সাথে সাথে গর্ভবতী মহিলাগণ নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো অনুভব করতে পারেন :
১. শরীর ফ্যাকাসে হওয়া ও প্রচুর ঘাম হওয়া।
২. বুক ধড়ফড় করা।
৩. নাড়ির স্পন্দন দ্রুত হওয়া।
৪. মাথা ঘোরা, সঙ্গে মাথা ব্যথাও হতে পারে।
৫. চোখে ঝাপসা দেখা।
৬. মুখের কোণে ও জিহ্বায় ঘা হওয়া।
৭. দুর্বলতা ও ক্লান্তিভাব।
৮. হজমে সমস্যা।
৯. এমনকি পুরো শরীর ফুলে গিয়ে সঙ্গে শ্বাস কষ্টও হতে পারে।
১০. অনিদ্রা কিংবা ঘুম কম হতে পারে।
১১. সহজে ক্ষতবিক্ষত ত্বক।
১২. পায়ের অনিচ্ছাকৃত নড়াচড়া (অস্থির পা সিন্ড্রোম)।
রোগ নির্ণয় ও পরীক্ষা
কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (সিবিসি) নামে একটি রক্ত পরীক্ষা অ্যানিমিয়া নির্ণয় করতে সহায়ক। রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ও হেমাটোক্রিট লেভেল পরীক্ষা রোগনির্ণয়ের জন্য জরুরি। এই রক্ত-পরীক্ষা প্রায়ই প্রথম প্রসবপূর্ব অ্যাপয়েন্টমেন্টের সময় ডাক্তারগণ করিয়ে থাকেন।
সিবিসি-এর ফলাফলে যদি দেখা যায়, হিমোগ্লোবিন এর পরিমাণ ৬.৫ থেকে ৭.৯ গ্রাম প্রতি ডেসিলিটার (g/dL), তখন একে সিভিয়ার অ্যানিমিয়া বা গুরুতর রক্তস্বল্পতা বলা হয়। এ অবস্থায় সাধারণত ব্লাড ট্রান্সফিউশন করতে বলা হয়।
ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসা
হালকা থেকে মাঝারি অ্যানিমিয়া হলে সাধারণত দৈনিক প্রসবপূর্ব ভিটামিন বা আয়রন সম্পূরক দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। এটি শরীরকে স্বাস্থ্যকর পরিমাণে আয়রন, ভিটামিন বি-১২ এবং ফলিক অ্যাসিড সরবরাহ করে।
গুরুতর অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা হলে রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন হতে পারে।
অ্যানিমিয়ার ক্ষেত্রে ডায়েট পরিবর্তন বেশ উপকারী হয়। পালং শাক, চর্বিহীন গরুর মাংস এবং টার্কির মতো বেশি আয়রনযুক্ত খাবার বেশি করে খাওয়া চাই। যেসব খাবারে ভিটামিন বেশি থাকে তা আয়রন শোষণ করতে সাহায্য করে (যেমন : ভিটামিন সি)। সাইট্রাস ফল, টমেটো ও কাঁচা মরিচ এর গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
শরীরে যদি আয়রনের ঘাটতি, বি-১২ এর ঘাটতি বা ফোলেট-স্বল্পতা অ্যানিমিয়া থাকে, তাহলে সাপ্লিমেন্ট নেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই লক্ষণগুলো কমতে শুরু করে। যদি কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা না যায়, দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া চাই।
যদি অ্যানিমিয়ার চিকিৎসা না করা হয় রক্তস্বল্পতা সময়ের সাথে আরও খারাপ হতে পারে। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়া শরীরের অঙ্গগুলির ক্ষতিসাধন করতে পারে। এটি হৃৎপিণ্ডকে আরও বেশি কাজ করতে বাধ্য করে নিম্নলিখিত ঝুঁকি বাড়ায় :
১. অ্যারিথমিয়া (অনিয়মিত হৃদস্পন্দন)।
২. হার্টের আকার বড় হয়ে যাওয়া
৩. হার্ট ফেইলিউর।
অ্যানিমিয়া প্রতিরোধ
গর্ভাবস্থায় রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধ করতে নিশ্চিত করা চাই যে গর্ভবতী মহিলা খাবারে পর্যাপ্ত আয়রন পান। সুষম খাবার খাওয়া ও ডায়েটে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার যোগ করা জরুরি।
আয়রন সমৃদ্ধ খাবারের দিনে অন্তত তিনটি পরিবেশন হওয়া চাই। চর্বিহীন লাল মাংস, মুরগি এবং মাছ, শাক, গাঢ় সবুজ শাকসবজি (যেমন : পালং শাক, ব্রকলি), আয়রন সমৃদ্ধ সিরিয়াল এবং শস্য, মটরশুটি, মসুর ডাল, বাদাম, বীজ, ডিম ইত্যাদি খাবার একেক পরিবেশনে একেকটি খাওয়া যেতে পারে।
যেসব খাবারে ভিটামিন সি বেশি থাকে সেগুলো শরীরকে আরও আয়রন শোষণ করতে সাহায্য করে। এর মধ্যে রয়েছে সাইট্রাস ফল এবং রস, স্ট্রবেরি, টমেটো, কাঁচা মরিচ ইত্যাদি। আপনি যে সময়ে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাচ্ছেন সেই সময়েই সেই খাবারগুলো খাওয়ার চেষ্টা করুন। উদাহরণস্বরূপ : আপনি এক গ্লাস কমলার রস পান করতে পারেন এবং প্রাতঃরাশের জন্য একটি আয়রন-ফর্টিফাইড সিরিয়াল খেতে পারেন।
এছাড়াও, ফোলেটের ঘাটতি রোধ করতে সাহায্য করার জন্য ফোলেট বেশি থাকে এমন খাবার বেছে নেয়া চাই। এর মধ্যে রয়েছে সবুজ শাকসবজি, সাইট্রাস ফল এবং ফলের রস, শুকনো মটরশুটি।
পর্যাপ্ত পরিমাণ আয়রন এবং ফলিক অ্যাসিড রয়েছে এমন একটি প্রসবপূর্ব ভিটামিন প্রত্যেক গর্ভবতীর ডাক্তারের নির্দেশাবলী অনুসরণ করে খাওয়া উচিত।
নিরামিষাশীদের তাদের ডাক্তারের সাথে কথা বলা উচিত যে তারা গর্ভবতী এবং বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় ভিটামিন বি-১২ সম্পূরক গ্রহণ করা উচিত কি না।
গর্ভাবস্থা নারীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়। এই সময়ে মানসিক ও শারীরিক উভয় ধরনের সুস্থতা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একজন সুস্থ মা-ই জন্ম দিতে পারেন একজন মেধাবী ও সুস্থ সন্তান।
লেখক :
টিউটর ও ফ্যাকাল্টি মেম্বার, ডিসট্যান্স লার্নিং প্রোগ্রাম (বারডেম), বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি।
চীফ ডায়াবেটোলজিস্ট, ডা. মাসিহ্‘স ডায়াবেটিস কেয়ার, হাটহাজারী।