শোকর ও কৃতজ্ঞতা
ঈমানী জীবনের আলোকিত পথ
কৃতজ্ঞতা মুমিনের মহান গুণ। তার ঈমানী যিন্দেগী ও আদর্শ জীবন গঠনের শ্রেষ্ঠতম অবলম্বন। সফলতা ও সৌভাগ্যের চাবিকাঠি। ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির পাথেয়। এটি আল্লাহ তাআলার নিকট অত্যন্ত পছন্দনীয় একটি গুণ। যে উক্ত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে তাকে তিনি আখেরাতে মহা পুরস্কারে ভূষিত করবেন। কুরআনুল কারীমে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন—
وَ اِنْ تَشْكُرُوْا يَرْضَهُ لَكُمْ.
তোমরা শোকর আদায় করলে তিনি তোমাদের জন্য তা পছন্দ করেন। Ñসূরা যুমার, (৩৯) : ৬
অপর এক আয়াতে ঘোষণা করেন—
وَسَنَجْزِي الشّٰکِرِيْنَ.
আমি কৃতজ্ঞদের অবশ্যই পুরষ্কৃত করব। —সূরা আলে ইমরান, (৩) : ১৪৫
কৃতজ্ঞতা মানব জীবনে বয়ে আনে প্রভূত কল্যাণ, খায়র ও বরকত, উন্নতি ও সমৃদ্ধি। নবীজী বলেন—
عَجَبًا لِأَمْرِ الْمُؤْمِنِ، إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ، وَلَيْسَ ذَاكَ لِأَحَدٍ إِلَّا لِلْمُؤْمِنِ، إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ، فَكَانَ خَيْرًا لَهُ، وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ، صَبَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ.
মুমিনের ব্যাপারটা বড়ই আশ্চর্যের! তার সকল অবস্থাই তার জন্য মঙ্গলজনক। এ প্রাপ্তি কেবল মুমিনেরই। সুখে থাকলে শোকর আদায় করে, এটা তার কল্যাণ। মুসিবতে পড়লে ধৈর্য ধারণ করে, সেটাও তার জন্য মঙ্গল। —সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৯৯৯
আরেক হাদীসে এসেছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন—
لَا يَرْزُقُ اللهُ عَبْدًا الشُّكْرَ فَيَحْرِمَهُ الزِّيَادَةَ لَأَنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ يَقُولُ: لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ.
যে বান্দাকে আল্লাহ তাআলা কৃতজ্ঞতার গুণ দান করেন, তাকে সমৃদ্ধি দান করা থেকে বঞ্চিত করেন না। কেননা আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, তোমরা শোকর আদায় করলে অবশ্যই আমি বাড়িয়ে দেব। —কিতাবুশ শোকর, ইবনে আবিদ দুনয়া, হাদীস ৩; শুআবুল ঈমান, হাদীস ৪৫২৬
ইসলামের শিক্ষা হল, উপকারীর উপকারের মূল্যায়ন করা এবং তার কৃতজ্ঞতা আদায় করা। এজন্য মুমিন যেমন আল্লাহ তাআলার নিআমতের শোকরের পাবন্দ, অনুরূপ দুনিয়াতে জীপনযাপন করতে গিয়ে যাদের সামান্যতম সাহায্য-সহযোগিতাও লাভ করবে তাদের শোকর আদায় করাও তার কর্তব্য। এটা তার ঈমানের দাবি, সাথে সাথে মানবতার দাবিও বটে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন—
مَنْ لَمْ يَشْكُرِ النَّاسَ، لَمْ يَشْكُرِ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ.
যে মানুষের শোকর আদায় করল না, সে আল্লাহরও শোকর আদায় করল না। —মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭৫০৪; জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯৫৪
নবীজী আরো বলেন—
إِنَّ أَشْكَرَ النَّاسِ لِلهِ أَشْكَرُهُمْ لِلنَّاسِ.
নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলার প্রতি সবার্ধিক কৃতজ্ঞ সে, যে মানুষের সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞতা আদায় করে। —মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২১৮৪৬
আরেক হাদীসে বলেন—
إِذَا حَشَرَ اللهُ الْخَلَائِقَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ قَالَ لِعَبْدٍ مِنْ عِبَادِهِ، اصْطَنَعَ إِلَيْهِ عَبْدٌ مِنْ عِبَادِهِ مَعْرُوفًا: هَلْ شَكَرْتَهُ؟ فَيَقُولُ: يَا رَبِّ عَلِمْتُ أَنَّ ذَلِكَ مِنْكَ فَشَكَرْتُكَ عَلَيْهِ فَيَقُولُ: لَمْ تَشْكُرْنِي إِذْ لَمْ تَشْكَرْ مَنْ أَجْرَيْتُ ذَلِكَ عَلَى يَدَيْهِ.
আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন যখন সমস্ত মাখলুককে একত্র করবেন, তখন তিনি তাঁর এক বান্দাকে বলবেন, যার প্রতি তাঁর অন্য কোনো বান্দা উপকার করেছিল, তুমি তার শোকর আদায় করেছিলে?
সে উত্তরে বলবে, হে আমার রব! আমি মনে করেছিলাম, এটা আপনার পক্ষ থেকে। তাই আপনার শোকর আদায় করেছিলাম।
আল্লাহ বলবেন, তুমি আমার শোকর আদায় করনি, যেহেতু তুমি তার কৃতজ্ঞতা আদায় করনি, যার মাধ্যমে তোমাকে নিআমতটুকু দান করেছিলাম। —মুজামে আওসাত তাবারানী, হাদীস ৩৬০৪; মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৮ : ১৮০
উপকারীর কৃতজ্ঞতা কীভাবে আদায় করব সেটিও নবীজী আমাদেরকে শিখিয়ে গেছেন। তিনি বলেন—
مَنْ أَتَى إِلَيْكُمْ مَعْرُوفًا فَكَافِئُوهُ، فَإِنْ لَمْ تَجِدُوا مَا تُكَافِئُوهُ، فَادْعُوا لَهُ، حَتَّى تَعْلَمُوا أَنْ قَدْ كَافَأْتُمُوهُ.
কেউ তোমাদের কোনো উপকার করলে তোমরা তার প্রতিদান দাও। আর প্রতিদান দেওয়ার সামর্থ্য না থাকলে তার জন্য দুআ করতে থাক, যে পর্যন্ত না বিনিময় আদায় হয়েছে বলে মনে হয়। —মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৫৩৬৫; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৩৩৭৫
অপর এক হাদীসে বলেন—
مَنْ أُعْطِيَ عَطَاءً فَوَجَدَ فَلْيَجْزِ بِهِ، وَمَنْ لَمْ يَجِدْ فَلْيُثْنِ، فَإِنَّ مَنْ أَثْنَى فَقَدْ شَكَرَ، وَمَنْ كَتَمَ فَقَدْ كَفَرَ.
যে ব্যক্তি কোনো অনুদান লাভ করল, সামর্থ্য থাকলে সে যেন তার প্রতিদান দেয়। আর সামর্থ্য না থাকলে, প্রশংসা করবে। কারণ, যে প্রশংসা করল সে শোকর আদায় করল। যে গোপন করল সে ব্যক্তি না শোকরী করল। —জামে তিরমিযী, হাদীস ২০৩৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৮১৩
দুআ ও প্রশংসা হিসেবে আমরা কমপক্ষে নিম্নোক্ত দুআটি করতে যেন ভুলে না যাই—
جَزَاكَ اللهُ خَيْرًا.
আল্লাহ তাআলা আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।
কারণ এটিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের বড় মাধ্যম। নবীজী বলেন—
مَنْ صُنِعَ إِلَيْهِ مَعْرُوفٌ فَقَالَ لِفَاعِلِهِ: جَزَاكَ اللهُ خَيْرًا فَقَدْ أَبْلَغَ فِي الثَّنَاءِ.
যার উপকার করা হল আর সে (কৃতজ্ঞতাস্বরূপ) جَزَاكَ اللهُ خَيْرًا বলল সে যথার্থ প্রশংসা করল। —জামে তিরমিযী, হাদীস ২০৩৫; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৩৪১৩
উক্ত গুণ মুমিনের ঈমান ও ইসলামের সৌন্দর্যকে প্রস্ফুটিত করে। ব্যক্তির নির্মল হৃদয় ও উন্নত চরিত্রের পরিচয় বহন করে। এজন্যই তো যে এই বৈশিষ্ট্য জীবনে ধারণ করে, তাকে সবাই শ্রদ্ধা করে। অন্তর থেকে ভালবাসে। তার উপকার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে এবং তার বিপদ-আপদে এগিয়ে আসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। ফলে তার পারিবারিক ও সমাজ জীবন হয়ে ওঠে অত্যন্ত সুখকর, আনন্দময়। গড়ে ওঠে পারষ্পরিক সৌহার্দ ও সম্প্রীতি। অপরদিকে পরকালীন সফলতা তো আছেই।
পক্ষান্তরে অকৃতজ্ঞতা অত্যন্ত ঘৃণিত ও নিন্দনীয় স্বভাব, যা সকলেই অপছন্দ করে। এটি মানুষের ব্যক্তিত্বকে মূল্যহীন করে। কলুষিত করে তার চরিত্র। এই স্বভাব দয়াময়ের অসন্তুষ্টি ডেকে আনে। আবার সমাজের মানুষও অকৃতজ্ঞ লোকদের ভালো চোখে দেখে না। ফলে ইহকাল ও পরকাল উভয় জগতেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
উক্ত স্বভাবের উপস্থিতি আমাদের নারী সমাজের মধ্যে তুলনামূলক বেশি লক্ষ্য করা যায়। তারা অন্যের ভালো ব্যবহার দেখে যেমন দ্রুত প্রভাবিত হন, আবার কারো থেকে কষ্ট পেলে, অপ্রত্যাশিত আচরণের সম্মুখীন হলে মুহূর্তেই বিমর্ষ হয়ে পড়েন। পূর্বের সমস্ত ইহসান ভুলে যাওয়ার প্রবণতাও তাদের অনেকের মধ্যে দেখা যায়। এক হাদীসে এসেছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা বললেন, আমাকে জাহান্নাম দেখানো হয়েছে। দেখলাম, জাহান্নামে নারীদের সংখ্যাই বেশি। এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে নবীজী বললেন—
يَكْفُرْنَ العَشِيرَ، وَيَكْفُرْنَ الإِحْسَانَ، لَوْ أَحْسَنْتَ إِلَى إِحْدَاهُنَّ الدَّهْرَ، ثُمَّ رَأَتْ مِنْكَ شَيْئًا، قَالَتْ: مَا رَأَيْتُ مِنْكَ خَيْرًا قَطُّ.
অর্থাৎ তারা স্বামীর অকৃতজ্ঞতা করে এবং ইহসান ও অনুগ্রহের না শোকরী করে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ তো এমন যে, যদি তার প্রতি সারাজীবন অনুগ্রহ কর, তারপর তোমার থেকে একটু ভিন্ন কিছু দেখতে পেল, তাহলে নির্দ্বিধায় বলে দেবে, তোমার কাছ থেকে কখনো ভালো কিছু পাইনি। —সহীহ বুখারী, হাদীস ২৯
আমরা যেন তাদের দলভুক্ত না হই। কেউ উপকার করলে যেন যথাযথ মূল্যায়ন করি, কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করি। কারো থেকে কখনো কষ্ট পেলে, তার পূর্বের কৃত ইহসান ও অনুগ্রহ স্মরণ করে সামান্য আঘাতকে ভুলে যাই, হৃদয় থেকে মুছে ফেলি। আবারও হাসিমুখে সাক্ষাৎ ও সদাচারণে সচেষ্ট হই। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন।