জুমাদাল আখিরাহ ১৪৪৩   ||   ফেব্রুয়ারি -এপ্রিল ২০২২

সূরা আহযাবে মাগফেরাতপ্রাপ্ত নারীর গুণাবলি

মাওলানা হুজ্জাতুল্লাহ

সূরা আহযাবের পঁয়ত্রিশ নং আয়াত নানা বিবেচনায় তাৎপর্যের অধিকারী। একইসঙ্গে দশটি গুণের উল্লেখ-সম্বলিত এ আয়াতটি নারীদের পক্ষে আরও বেশি তাৎপর্যবহ। কারণ আয়াত অবতরণের প্রেক্ষাপট অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, আয়াতটি অবতরণের ক্ষেত্রে নারীদের আশা-আকাক্সক্ষার ভূমিকা ছিল। বিষয় হল, কুরআন মাজীদে মুমিনদের কোনো বিষয়ে হেদায়েত-নির্দেশনা কিংবা আদেশ-নিষেধ বা সুসংবাদ প্রভৃতি প্রদান করার ক্ষেত্রে সাধারণত পুংলিঙ্গের শব্দ ব্যবহার করা হয়। নারীগণ যদিও সেই বিষয়ের আওতাভুক্ত থাকে, কিন্তু তাদের কথা আলাদা করে উল্লেখ করা হয় না সবসময়। উদাহরণত, বলা হয়, হে মুমিনগণ! বা আপনি মুমিনদের সুসংবাদ দিনপ্রভৃতি। হে মুমিন নারীগণ বা আপনি মুমিন নারীগণকে সুসংবাদ দিন- এরকম বলা হয় কম। আরবী ভাষার মতো পৃথিবীর আরও অনেক ভাষাতেই সম্বোধন বা নির্দেশনা প্রদানের রীতি এরকম। অর্থাৎ কেবল পুংলিঙ্গের শব্দ ব্যবহার করে সম্বোধন বা নির্দেশনা প্রদান করা হয়, নারীগণও উক্ত বিষয়ের আওতাভুক্ত থাকে, কিন্তু আলাদাভাবে নারীদের কথা উল্লেখ করা হয় না। আমাদের বাংলা ভাষার রীতিও তাই।

মানুষের মনে কতরকম ইচ্ছাই তো জাগে। শরীয়তের গণ্ডির মাঝে থাকলে মনে ইচ্ছা-অভিলাষ জাগা মন্দ কিছু নয়। বরং নেক তামান্নার বদৌলতে মানুষ সওয়াব পায়। পুরুষদের প্রতি সম্বোধনের এই রীতি দেখে কতক নারী সাহাবীর মনে আশা জেগেছিল, আল্লাহ তাআলা যদি নারীদেরকে সম্বোধন করে বা নারীদের কথা উল্লেখ করে কোনো নির্দেশনা প্রদান করতেন! কারো কারো মনের আশা মুখের ভাষায়ও রূপান্তরিত হয়েছিল1আল্লাহ তাআলা যদি আমাদের কথাও কুরআনে বলতেন! হৃদয়-গভীরে যে মহান রাব্বুল আলামীন আশার সঞ্চার করেন তিনি তো মনের আশা এবং মুখের ভাষা সবই বোঝেন, আল্লাহ রব্বুল আলামীন সেই নারী সাহাবীদের মনের বাসনা পূর্ণ করেছিলেন। আশা পূরণার্থে মুমিন নারীদের কথা উল্লেখ করে সূরা আহযাবে আয়াত নাযিল হয়-

اِنَّ الْمُسْلِمِيْنَ وَ الْمُسْلِمٰتِ وَ الْمُؤْمِنِيْنَ وَ الْمُؤْمِنٰتِ وَ الْقٰنِتِيْنَ وَ الْقٰنِتٰتِ وَ الصّٰدِقِيْنَ وَ الصّٰدِقٰتِ وَ الصّٰبِرِيْنَ وَ الصّٰبِرٰتِ وَ الْخٰشِعِيْنَ وَ الْخٰشِعٰتِ وَ الْمُتَصَدِّقِيْنَ وَ الْمُتَصَدِّقٰتِ وَ الصَّآىِٕمِيْنَ وَ الصّٰٓىِٕمٰتِ وَ الْحٰفِظِيْنَ فُرُوْجَهُمْ وَ الْحٰفِظٰتِ وَ الذّٰكِرِيْنَ اللّٰهَ كَثِيْرًا وَّ الذّٰكِرٰتِ ۙ اَعَدَّ اللّٰهُ لَهُمْ مَّغْفِرَةً وَّ اَجْرًا عَظِيْمًا

নিশ্চয়ই মুসলিম পুরুষ ও মুসলিম নারী, মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী, একনিষ্ঠ মনে আনুগত্যকারী পুরুষ ও একনিষ্ঠ মনে আনুগত্যকারী নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও ধৈর্যশীল নারী, আল্লাহর ভয়ে ভীত বিনয়-বিনম্র পুরুষ ও আল্লাহর ভয়ে ভীত বিনয়-বিনম্র নারী, সদকাকারী পুরুষ ও সদকাকারী নারী, রোযাদার পুরুষ ও রোযাদার নারী, লজ্জাস্থানের হেফাজতকারী পুরুষ ও লজ্জাস্থানের হেফাজতকারী নারী, আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও অধিক স্মরণকারী নারী- আল্লাহ এদের সকলের জন্য মাগফেরাত ও মহা প্রতিদান প্রস্তুত করে রেখেছেন। -সূরা আহযাব (৩৩) : ৩৫

এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা দশটি গুণের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, যে নর ও নারীর মাঝে এই দশটি গুণ থাকবে, আল্লাহ তাআলা তাকে ক্ষমা করে দেবেন এবং তাকে মহা পুরস্কার দান করবেন।

এক. ইসলাম

ইসলাম শব্দের শাব্দিক অর্থ আত্মসমর্পণ করা। এখানে উদ্দেশ্য হল, আল্লাহর বিধানের সামনে নিজেকে সমর্পণ করে দেয়া। আরও খোলাসা করে বললে, দ্বীনে ইসলামকে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত সত্য দ্বীন হিসেবে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা ও মন থেকে গ্রহণ করা। অতঃপর ইসলামের সকল বিধান দ্বিধাহীনচিত্তে মানার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে যাওয়া। এই মানসিক আত্মসমর্পণ খুব জরুরি। এর জন্য প্রয়োজন মজবুত ঈমান ও দৃঢ় বিশ্বাস।

একজন মানুষ ইসলাম গ্রহণ করার অর্থ হল, ইসলাম আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত দ্বীন এবং ইসলামের সকল বিধান স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত- এই বিশ্বাস মনে দৃঢ়ভাবে বদ্ধমূল করে নিয়ে ইসলামের সকল বিধান পালনের জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হওয়া। ইসলাম গ্রহণ করার মানেই হল, মুসলিম এ কথা মন থেকে বিশ্বাস ও গ্রহণ করে নিয়েছে যে, এই দ্বীন আমার খালিক ও মালিক আল্লাহ রব্বুল আলামীন আমাদেরকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে প্রদান করেছেন। কাজেই এই দ্বীনের সকল বিধান স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানার জন্য আমি সদা প্রস্তুত থাকব। এই মানসিক আত্মসমর্পণ এবং বাস্তব জীবনে তার প্রতিফলনের নামই ইসলাম। এই চেতনা-বিশ্বাস এবং এর প্রতিফলন যার জীবনে ঘটে সে-ই হল মুসলিম।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিচ্ছিন্ন হলেও লক্ষ্য করা যায়, কতক লোক ইসলামের কোনো কোনো বিধান মানার ব্যাপারে মানসিকভাবেপ্রস্তুত নয়; কিন্তু তারা নিজেদেরকে ইসলামের অনুসারী বলেই দাবি করে। অথচ ইসলাম অনুসরণের অনিবার্য দাবি হল, ইসলামকে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত সর্বশেষ দ্বীন এবং ইসলামের সকল বিধান খোদ আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত- এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা। কোনো বিধান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত- এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা সত্তে¡ও তা মন থেকে গ্রহণ করতে না পারা কীভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? মন থেকে ইসলামের একটি বিধানও যদি কেউ মানতে না পারে, তার মানে হল, ইসলাম আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত দ্বীন-এ বিষয়ে তার বিশ্বাসে ঘাটতি আছে। কিংবা তিনি আপন বিশ্বাসের প্রতি সৎ নন। কিংবা নিজের বিশ্বাসের ব্যাপারে উদাসীন। অন্ততপক্ষে অসচেতন। এই সবকিছুই সংশোধনের দাবি রাখে। আমাদের ঈমান ও বিশ্বাস দৃঢ় হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন অটল ও অবিচল ঈমান। ঈমান মজবুত হলেই পূর্ণাঙ্গ আত্মসমর্পণ সম্ভব হবে এবং আমরা সত্যিকার মুসলিম হতে পারব।

প্রকাশ থাকে যে, মন থেকে গ্রহণ করার পর এবং বিধান পালনের পূর্ণ ইচ্ছা থাকা সত্তে¡ও কখনো অলসতা কিংবা উদাসীনতার কারণে নির্দিষ্ট কোনো বিধান পালনে অবহেলা হয়ে থাকে কারো কারো। অলসতা ও উদাসীনতা পরিহার করে ইসলামের সকল বিধান যথাযথভাবে পালন করা তো অবশ্যই কর্তব্য। তবে আমরা এখানে যে বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছি তা হল, মন থেকে গ্রহণ করার বিষয়টি। কেনো বিধান মন থেকে গ্রহণ করতে না পারা কিংবা গ্রহণ করতে না চাওয়া অত্যন্ত মারাত্মক। এটি কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

দুই. ঈমান

আয়াতের দ্বিতীয় আলোচ্য বিষয় ঈমান। ঈমান অর্থ দৃঢ় বিশ্বাস। এই ঈমানই ইসলামের মূল ভিত্তি। আমরা জানি, মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে তার মন ও মনন। মানুষের আচার-আচরণ ও কাজ-কর্মে তার ভাবনা-চিন্তা ও বিশ্বাসেরই প্রতিফলন ঘটে। তাই ইসলাম মানুষের চিন্তা ও বিশ্বাসজগৎকে সর্বাধিক গুরুত্ব দান করেছে। এবং সঠিক বিশ্বাসজগৎ বিনির্মাণের জন্য পরিপূর্ণ রূপরেখা প্রদান করেছে। ঈমান ও বিশ্বাসের বিষয় তো অনেক। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, আল্লাহর প্রতি ঈমান, আল্লাহর রাসূলগণের প্রতি ঈমান, আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান, আল্লাহর ফেরেশতাগণের প্রতি ঈমান, তাকদীরের প্রতি ঈমান, শেষ দিবসের প্রতি ঈমান।

এগুলো ঈমানের মূল স্তম্ভ। ঈমানের আরো অনেক শাখা-প্রশাখা রয়েছে। ঈমানের সকল শাখা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখা অপরিহার্য। নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে ঈমানের সকল শাখা-প্রশাখা সম্পর্কে জানা এবং অন্তরে তা বদ্ধমূল করা আবশ্যক।

তিন. একনিষ্ঠ মনে আনুগত্য

কুরআন মাজীদের শব্দ হল, (القنوت)কুনূত অনেক গভীর ও ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। একনিষ্ঠ মনে আল্লাহর হুকুম-আহকামের আনুগত্য করা এবং আল্লাহর প্রতি অভিনিবিষ্ট ও সমর্পিত হয়ে ইবাদত-বান্দেগী করা- এই সবকিছু এই শব্দে শামিল। এখানে উদ্দেশ্য, আল্লাহর প্রতি পূর্ণ সমর্পণ ও একনিষ্ঠ আনুগত্য।

চার. সততা ও সত্যবাদিতা

মুমিন নর-নারীর চতুর্থ গুণ কথায় ও কাজে সত্যবাদিতা। মুমিন নর-নারী কথায় ও কাজে সত্যবাদী হবে।

পাঁচ. ধৈর্য

ইসলাম মুমিন নর-নারীর কাছে মৌলিকভাবে তিন ক্ষেত্রে ধৈর্য কামনা করে। (১) নেক কাজ করার ক্ষেত্রে ধৈর্যের পরিচয় দেয়া। (২) হারাম ও সন্দেহযুক্ত বিষয় পরিহার করার ক্ষেত্রে ধৈর্যের পরিচয় দেয়া। (৩) বিপদ-আপদে ধৈর্যের পরিচয় দেয়া।

নেক কাজ করার জন্য মন প্রস্তুত হওয়া আল্লাহর বড় নিআমত। নেক কাজের জন্য যাদের মন-দিল প্রস্তুত হয় তাদের উচিত আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার পাশাপাশি নেক কাজ যেন সবসময় করে যেতে পারে তার জন্য তাওফীক প্রার্থনা করা। কখনো এমন হয় যে, একটি নেক কাজ করার তাওফীক তো হয়েছে, কিন্তু সেটি সবসময় করে যাওয়ার জন্য ধৈর্য হচ্ছে না। তখন ধৈর্য ধরে নেক কাজটি করার চেষ্টা করে যাওয়া উচিত। এ তো গেল যাদের মন প্রস্তুত হয় তাদের কথা। যাদের নেক কাজ করার জন্য মন প্রস্তুত হয় না, তাদের ক্ষেত্রে শরীয়তের হুকুম হল, মন প্রস্তুত না হলেও ধৈর্য ধরে কাজে লেগে থাকা। এ ক্ষেত্রে ধৈর্যের পরিচয় দেয়া এবং ধৈর্য ধরে নিজেকে কাজে লাগিয়ে রাখা খুব জরুরি।

তদ্রূপ হারাম ও গোনাহের কাজ থেকে আত্মরক্ষার তাওফীক যাদের হয় তাদের তো শুকরিয়া আদায় করা কর্তব্য। কিন্তু কখনো যদি মনে গোনাহ করার খাহেশ জন্মায় তাহলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং ধৈর্য ধরা জরুরি।

ধৈর্যের তৃতীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হল বিপদ-আপদ। মানুষের জীবনের অনিবার্য বাস্তবতা হল, জীবনে অনুকূল পরিস্থিতি যেমন থাকবে তেমনই প্রতিকূল পরিস্থিতিরও সম্মুখীন হতে হবে। অনুকূল পরিস্থিতিতে শোকর আদায় করা আর প্রতিকূল অবস্থায় ধৈর্য ধরা জরুরি।

এই তিনটি হল ধৈর্যের মৌলিক ক্ষেত্র, এগুলোর অধীনে আরো অনেক শাখাক্ষেত্র আছে। এই তিন মৌলিক ক্ষেত্র ও শাখাক্ষেত্রসমূহে ধৈর্যধারণের জন্য ধৈর্যের অনুশীলন করাও প্রয়োজন। অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রমাণিত, অনুশীলনের মাধ্যমে যে কোনো কাজ সহজ হয়ে আসে। অনুশীলনের মাধ্যমে ধৈর্যধারণের ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। ধৈর্যধারণের উপরিউক্ত কুরআনী নির্দেশনা পালনের লক্ষ্যে ধৈর্যের অনুশীলন করা হলে সওয়াব পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ।

ছয়. আল্লাহর ভয়ে বিনয়-বিনম্র থাকা

আল্লাহর ভয় মনে জাগরূক রাখা এবং বিনীত ও বিনম্র থাকা মুমিন নর-নারীর অন্যতম গুণ। বিশেষত ইবাদত-বান্দেগীতে বিনয় ও নম্রতার প্রতি লক্ষ্য রাখা অত্যন্ত জরুরি।

সাত. দান-সদকা

দান-সদকা গোনাহ মাফের ও মাগফিরাত লাভের অন্যতম মাধ্যম। মুয়ায ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে আছে-

وَالصَّدَقَةُ تُطْفِئُ الخَطِيئَةَ كَمَا يُطْفِئُ المَاءُ النَّارَ.

সদকা গোনাহকে মিটিয়ে দেয়, যেভাবে পানি আগুনকে নিভিয়ে দেয়। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬১৬

আট. রোযা

রোযা জাহান্নাম থেকে মুক্তির এবং জান্নাত লাভের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। এক হাদীসে আছে-রোযা হল (জাহান্নাম থেকে রক্ষার) ঢাল-জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬১৬

হযরত সাহল ইবনে সাদ রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

إِنّ فِي الجَنّةِ بَابًا يُقَالُ لَهُ الرّيّانُ، يَدْخُلُ مِنْهُ الصّائِمُونَ يَوْمَ القِيَامَةِ، لاَ يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ، يُقَالُ : أَيْنَ الصّائِمُونَ؟ فَيَقُومُونَ، لاَ يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ، فَإِذَا دَخَلُوا أُغْلِقَ فَلَمْ يَدْخُلْ مِنْهُ أَحَدٌ.

জান্নাতে একটি দরজা আছে, যার নাম রাইয়ান। কিয়ামতের দিন এ দরজা দিয়ে কেবল রোযাদার ব্যক্তিরাই প্রবেশ করবে। অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা করা হবে, কোথায় সেই (সৌভাগ্যবান) রোযাদারগণ? তখন তারা উঠে দাঁড়াবে। তারা ব্যতীত কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। অতঃপর রোযাদারগণ যখন প্রবেশ করবে, তখন তা বন্ধ করে দেয়া হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৮৯৬

নয়. লজ্জাস্থানের হেফাজত

এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয়। একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছয়টি আমলের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, পাবন্দির সাথে যে ব্যক্তি সেই ছয়টি বিষয় পালন করবে, তিনি তার জন্য জান্নাতের জামানত নিয়েছেন। তন্মধ্যে একটি হল, লজ্জাস্থানের হেফাজত। উবাদা বিন সামেত রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

اضْمَنُوا لِي سِتًّا مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَضْمَنْ لَكُمُ الْجَنَّةَ: اصْدُقُوا إِذَا حَدَّثْتُمْ، وَأَوْفُوا إِذَا وَعَدْتُمْ، وَأَدُّوا إِذَا اؤْتُمِنْتُمْ، وَاحْفَظُوا فُرُوجَكُمْ، وَغُضُّوا أَبْصَارَكُمْ، وَكُفُّوا أَيْدِيَكُمْ.

তোমরা আমাকে ছয়টি বিষয়ের নিশ্চয়তা দাও, আমি তোমাদের জন্য জান্নাতের জামানত নেব। যখন কথা বলবে সত্য বলবে, ওয়াদা করলে তা পূর্ণ করবে, তোমাদের কাছে আমানত রাখা হলে আমানত আদায় করবে, লজ্জাস্থান হেফাজত করবে, দৃষ্টি অবনমিত রাখবে এবং (মানুষকে কষ্ট দেয়া থেকে) হাত সংযত রাখবে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২৭৫৭; সহীহ ইবনে হিব্বান ২৭১

লজ্জাস্থান হেফাজতের শরীয়ত নির্দেশিত একটি পন্থা হল, শরীয়তসম্মত পন্থায় বিবাহ করা। লজ্জাস্থান হেফাজতের ক্ষেত্রে সাধারণত ত্রুটি ঘটে যৌনকামনার কারণে। যৌনকামনা মানুষের স্বভাবজাত একটি প্রবৃত্তি। ইসলাম যৌনকামনা একেবারে দমন করে ফেলার কথা বলেনি, বরং তা জায়েয পন্থায় পূর্ণ করার নির্দেশনা প্রদান করেছে। আর তা হল, শরীয়তসম্মত পন্থায় বিবাহ। বিবাহের বিধান মুসলিম উম্মাহর জন্য অনেক বড় রহমত ও নিআমত । কিন্তু আফসোস! এই বিধানের ব্যাপারে আজকাল বেশ অবহেলা দেখা যায়। অযৌক্তিক নানা কারণে বিবাহে দেরি করা হয়; অতঃপর লজ্জাস্থান হেফাজতের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গাফিলতির শিকার হয়।

লজ্জাস্থান হেফাজতের জন্য আরেকটি জরুরি বিষয় হল, চোখের হেফাজত। সাধারণত চোখের গোনাহের মাধ্যমেই বড় গোনাহের সূচনা হয়। তাই এ বিষয়েও সচেতনতা জরুরি। চোখের গোনাহ থেকে বাঁচার জন্য পর্দার বিধানের ব্যাপারেও সচেতনতা প্রয়োজন। এই দুই বিধানের ব্যাপারে আমাদের সমাজজীবনে যে কী অসচেতনতা তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রত্যেকে যদি নিজ নিজ পরিসরে সচেতন হই এবং আন্তরিকভাবে চেষ্টা করি তাহলে এই ধ্বংসাত্মক গোনাহগুলো থেকে আত্মরক্ষা করা আমাদের জন্য সহজ হবে। এর জন্য প্রয়োজন সৎ সাহস ও দৃঢ় সংকল্প এবং ইসলামের বিধানাবলির প্রতি আন্তরিকতা।

দশ. বেশি বেশি আল্লাহর স্মরণ ও যিকির

বেশি বেশি আল্লাহর যিকির করা এবং আল্লাহকে স্মরণ করাও মুমিন নর-নারীর অনিবার্য গুণ। সূরা আহযাবেরই অপর এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اذْكُرُوا اللّٰهَ ذِكْرًا كَثِيْرًا.

হে ঈমানদারগণ! তোমরা বেশি বেশি আল্লাহকে স্মরণ কর। -সূরা আহযাব (৩৩) : ৪১

একবার এক সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে আরয করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ!

إِنَّ شَرَائِعَ الإِسْلَامِ قَدْ كَثُرَتْ عَلَيَّ، فَأَخْبِرْنِي بِشَيْءٍ أَتَشَبَّثُ بِهِ.

অর্থাৎ আমার সামনে নেক আমল তো অনেক, আমাকে এমন কিছুর কথা বাতলে দিন, যা আমি আঁকড়ে ধরতে পারি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জবাবে বললেন-

لَا يَزَالُ لِسَانُكَ رَطْبًا مِنْ ذِكْرِ اللهِ.

তোমার জিহ্বা যেন সদা আল্লাহর যিকিরে সিক্ত থাকে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৩৭৫; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৮১৪

হযরত আবু মূসা আশআরী রা. বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مَثَلُ الْبَيْتِ الَّذِي يُذْكَرُ اللهُ فِيهِ، وَالْبَيْتِ الَّذِي لَا يُذْكَرُ اللهُ فِيهِ، مَثَلُ الْحَيِّ وَالْمَيِّتِ

যে ঘরে আল্লাহর যিকির করা হয় আর যে ঘরে আল্লাহর যিকির করা হয় না, তার উদাহরণ হল জীবিত ও মৃতের ন্যায়। (অর্থাৎ যে ঘরে আল্লাহকে স্মরণ করা হয় তা জীবিত আর যে ঘরে স্মরণ করা হয় না তা মৃত)। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৭৯

শেষকথা

আল্লাহ তাআলা আপন অনুগ্রহে আমাদের সবাইকে উক্ত দশটি গুণ এবং এছাড়া মুমিন নর-নারীর আরো যত অনিবার্য গুণ আছে সেগুলো অর্জন করার তাওফীক দান করুন। এ লক্ষ্যে সৎ সাহস ও দৃঢ় সংকল্প নিয়ে যথাযথ পদ্ধতিতে চেষ্টা ও অনুশীলন করারও তাওফীক দান করুন- আমীন।

 

টীকা :

০১. মুসনাদে আহমাদের একটি হাদীসে (২৬৫৭৫) আছে, উম্মে সালামা রা. এ আশা ব্যক্ত করেছিলেন। হাদীসটির সনদ নির্ভরযোগ্য। হাদীসটি ইমাম নাসায়ীও সুনানে কুবরাতে (১১৩৪১) উল্লেখ করেছেন। জামে তিরমিযীর এক হাদীসে (৩২১১) আছে, উম্মে উমারা আনসারীয়া রা.ও এমন আশা ব্যক্ত করেছিলেন। এই হাদীসের সনদও নির্ভরযোগ্য। হতে পারে তাঁদের উভয়ের মনেই আশা জেগেছিল। (দ্রষ্টব্য, রুহুল মাআনী)

০২।

هذا لفظ مسلم، ولفظ البخاري >مَثَلُ الَّذِي يَذْكُرُ رَبَّهُ وَالَّذِي لاَ يَذْكُرُ رَبَّهُ، مَثَلُ الحَيِّ وَالمَيِّتِ<، ورجَّحَ الحافظُ ابن حجر روايةَ مسلمٍ على رواية البخاري، يُنظر فتح الباري للحافظ بالرقم (6407)

 

 

advertisement