পারিবারিক জীবনেও আছে কুরআনের বিধান
আমাদের পারিবারিক জীবনটিও ইসলামের বিধিবিধানের বাইরে নয়। স্বামী-স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, পিতামাতা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে যে যুথবদ্ধ জীবন, তার নীতিমালাও ইসলামী শরীয়তে নির্দেশিত হয়েছে। সমষ্টিগত জীবনে পারস্পরিক দায়িত্ব ও অধিকারের বিষয়টি অনিবার্যভাবেই চলে আসে। এ দুই বিষয় সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা এবং বাস্তব ক্ষেত্রে এর নিষ্ঠাপূর্ণ অনুসরণ ছাড়া পারিবারিক জীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব নয়। ইসলামের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য এই যে, মানবজীবনের এই অতিপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলো পবিত্র কুরআন-সুন্নাহয় সুনির্দিষ্টভাবে নির্দেশিত হয়েছে। কুরআন-সুন্নাহর অনুসরণের মাধ্যমে একটি সুখী ও সুন্দর পারিবারিক জীবন লাভ করা সম্ভব।
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে—
قَدْ جَآءَكُمْ مِّنَ اللٰهِ نُوْرٌ وَّ كِتٰبٌ مُّبِیْنٌ ۙ۱۵ یَّهْدِیْ بِهِ اللٰهُ مَنِ اتَّبَعَ رِضْوَانَهٗ سُبُلَ السَّلٰمِ وَ یُخْرِجُهُمْ مِّنَ الظُّلُمٰتِ اِلَی النُّوْرِ بِاِذْنِهٖ وَ یَهْدِیْهِمْ اِلٰی صِرَاطٍ مُّسْتَقِیْمٍ
‘নিঃসন্দেহে তোমাদের কাছে আল্লাহ (তাআলার) তরফ থেকে এক আলো ও সুস্পষ্ট কিতাব এসে গেছে। এর মাধ্যমে আল্লাহ (তাআলা) তাদেরকে শান্তির পথসমূহ দেখিয়ে দেন যারা তাঁর সন্তুষ্টির অনুসরণ করতে থাকে। আর তাদেরকে নিজ তাওফীকে অন্ধকারসমূহ থেকে আলোর দিকে নিয়ে আসেন এবং তাদেরকে সোজা পথ দেখিয়ে দেন।’ —সূরা মায়েদা (৫) : ১৫-১৬
জীবনের সব ক্ষেত্রের জন্যই কুরআন কারীম নূর ও আলো। আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদত-বন্দেগী, পারস্পরিক সম্পর্ক, লেনদেন, আখলাক ও নৈতিকতা ইত্যাদি সব বিষয়েই ইসলামে রয়েছে সুস্পষ্ট ও কল্যাণকর নির্দেশনা। এই নির্দেশনা অনুসরণের মাধ্যমে দুনিয়াতে শান্তিময় পবিত্র জীবন এবং আখেরাতে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও চিরশান্তি লাভ করা সম্ভব।
মুসলমানের দ্বীন ও দুনিয়া একটি অপরটি থেকে আলাদা নয়। মুসলমানের ঘর ও মসজিদ দুটি পরস্পর বিরোধী জগৎ নয়। মসজিদে যেমন আল্লাহ তাআলা আমাদের রব, কুরআন কারীম আমাদের কিতাব, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের রাসূল, ঘরের পারিবারিক জীবনেও তেমনই। দোকানপাট, অফিস-আদালত সব ক্ষেত্রেই এই কথা।
আমাদের পারিবারিক জীবনের বড় বড় দায়িত্ব থেকে শুরু করে একদম ছোট ছোট কাজও, এমনকি একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়েও শরীয়তের বিধিবিধান আছে। এই বিষয়গুলোকে একান্ত দুনিয়াবী কাজকর্ম মনে করে শরীয়তের আওতামুক্ত ভাবার সুযোগ নেই। এখানেও হালাল-হারাম, ফরয-ওয়াজিব আছে। সওয়াব-গোনাহর প্রশ্ন আছে। পারিবারিক জীবনের কাজকর্মের ব্যাপারেও কেয়ামতের দিন মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে এবং পুরস্কৃত বা তিরস্কৃত হতে হবে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে—
وَ قُلِ اعْمَلُوْا فَسَیَرَی اللٰهُ عَمَلَكُمْ وَ رَسُوْلُهٗ وَ الْمُؤْمِنُوْنَ ؕ وَ سَتُرَدُّوْنَ اِلٰی عٰلِمِ الْغَیْبِ وَ الشَّهَادَةِ فَیُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُوْنَ
‘আপনি বলে দিন, তোমরা কাজ করতে থাক। আল্লাহ তোমাদের কাজ-কর্ম দেখবেন এবং রাসূল ও মুমিনগণ দেখবেন। আর তোমরা অচিরেই প্রত্যাবর্তিত হবে তাঁর কাছে, যিনি প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সব বিষয় সম্পর্কে জানেন। তিনি তখন তোমাদের জানাবেন, তোমরা কী করতে।’ —সূরা তওবা (৯) : ১০৫
মানুষ প্রকাশ্যে যা করে তা যেমন আল্লাহ তাআলা জানেন, তেমনই তার একান্ত জীবনের কাজ-কর্ম, আচার-আচরণও জানেন। এই সবকিছু তাঁর কাছে সংরক্ষিত।
فَمَنْ یَّعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَیْرًا یَّرَهٗ ؕ۷ وَ مَنْ یَّعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرا یَّرَهٗ
‘যে এক ‘র্যারা’ পরিমাণ ভালো করবে, সে তা দেখতে পাবে; তেমনই যে এক ‘র্যারা’ পরিমাণ মন্দ করবে সে তাও দেখতে পাবে।’
কাজেই পারিবারিক জীবনেও আমাদেরকে আল্লাহ তাআলার হুকুম মোতাবেক চলতে হবে। স্ত্রী-পুত্র-পরিজনের জন্য আয়-উপার্জন, তাদের শিক্ষা-দীক্ষা ও অন্যান্য প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা, সদাচার-সদ্ব্যবহার এই সবকিছুর পেছনে আল্লাহ তাআলাকে সন্তুষ্ট করার প্রেরণা কার্যকর থাকতে হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হলে এ কাজগুলোতেও সওয়াব পাওয়া যাবে। এক হাদীসে ইরশাদ হয়েছে—
إِذَا أَنْفَقَ المُسْلِمُ نَفَقَةً عَلَى أَهْلِهِ، وَهُوَ يَحْتَسِبُهَا، كَانَتْ لَهُ صَدَقَةً.
‘যখন মুসলিম তার পরিবারের জন্য খরচ করে এবং এর বিনিময়ে সওয়াবের আশা করে, এটা তার জন্য সদকারূপে পরিগণিত হবে।’ —সহীহ বুখরী, হাদীস ৫৩৪১; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০০২ হযরত আবু মাসউদ বদরী রা.-এর সূত্রে
অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন—
إِذَا صَلَّتِ الْمَرْأَةُ خَمْسَهَا، وَصَامَتْ شَهْرَهَا، وَحَفِظَتْ فَرْجَهَا، وَأَطَاعَتْ زَوْجَهَا قِيلَ لَهَا : ادْخُلِي الْجَنَّةَ مِنْ أَيِّ أَبْوَابِ الْجَنَّةِ شِئْتِ.
‘যে নারী পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করে, রমযান মাসে রোযা রাখে, লজ্জাস্থানের হেফাজত করে এবং স্বামীর আনুগত্য করে তাকে বলা হবে, তুমি যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা জান্নাতে প্রবেশ কর।’ —মুসনাদে আহমদ, হাদীস ১৬৬১
তাহলে দেখা যাচ্ছে, পরিবারের জন্য খরচ করাও সওয়াবের কাজ। তেমনই স্ত্রী স্বামীর আনুগত্য করাও সওয়াবের কাজ, আখেরাতের কাজ। এসবের মাধ্যমেও আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জিত হয়। মুমিনের জন্য এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে? এজন্য পারিবারিক জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রেও আল্লাহ তাআলার আদেশ-নিষেধ সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে এবং সে অনুযায়ী চলার চেষ্টা করতে হবে। পারিবারিক জীবনের কাজকর্মগুলোও যদি ‘নেক আমল’ হয়ে যায় তাহলে চিন্তা করে দেখুন, নেক আমলের পাল্লা ভারী হওয়ার ক্ষেত্রে তা কতই না সহায়ক হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দিন।