মহীয়সী নারীদের জীবনকথা
উম্মাহর মহান আলেম : পেছনের অবদান মায়ের
ইমাম মালেক রাহ.-এর আম্মা
ইমাম মালেক রাহ.-এর মুহতারামা আম্মার নাম আলীয়া বিনতে শারীক ইবনে আবদুর রাহমান ইবনে শারীক আযদী। অত্যন্ত জ্ঞানী ও বুদ্ধিমতী নারী ছিলেন তিনি।
তিনি নিজ ছেলে মালেক রাহ.-এর শিক্ষা-দীক্ষার বিষয়ে বিশেষ মনোযোগী ছিলেন। ইমাম মালেক রাহ. বলেন, আমি আমার আম্মাকে বললাম, আমি ইলমে দ্বীন শিখব।
একথা শুনে তিনি বললেন, এসো, আমি তোমাকে আলেমদের পোশাক পরিয়ে দিই।
তিনি আমার মাথায় লম্বা টুপি পরালেন। টুপির উপর পাগড়ী বেঁধে দিয়ে বললেন, রাবীআতুর রাঈ রাহ.-এর মজলিসে যাও এবং তাঁর ইল্ম শেখার পূর্বে তাঁর আখলাক ও আদব শিখে নাও।
অন্য বর্ণনায় আছে, মা বললেন যাও, হাদীস পড় এবং লেখ। —তারতীবুল মাদারিক ১/৭২
ঐ সময় ইমাম রবীআতুর রাঈ রাহ.-এর দরস মসজিদে নববীতে হত এবং মদীনার সম্ভ্রান্ত ও গণ্যমান্য লোকেরা তাতে শরীক হতেন। রাবীআতুর রাঈ ছিলেন ইমাম মালেক রাহ.-এর প্রথম শায়েখ ও উস্তায, যাঁর একান্ত মনোযোগ তাঁর উপর নিবদ্ধ হয়েছিল। ফলে তাঁর মজলিসের এ তালিবুল ইলম ভবিষ্যতে মুসলিম উম্মাহর ইমামরূপে বরিত হয়েছিলেন। এর পেছনে ছিল এক মহীয়সী নারীর মহান অবদান, যার কাছে মুসলিম উম্মাহ ঋণী। তিনি হলেন তাঁর মা আলীয়া বিনতে শারীক।
সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা রাহ.-এর আম্মা
হযরত সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা রাহ. ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ তাবে-তাবেয়ী। তিনি ইমাম শাফেয়ী রাহ.-এর উস্তায ছিলেন। ইমাম শাফেয়ী রাহ. বলেন, মালেক ও সুফিয়ান না থাকলে হিজাযের ইলম খতম হয়ে যেত।
সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা রাহ.-এর মা তাকে যেভাবে লালন-পালন করেছেন, ইলমে দ্বীন শিক্ষা দিয়েছেন, তাতে মুসলিম মায়েদের জন্য যথেষ্ট শিক্ষার উপাদান রয়েছে। ওয়াকী ইবনে জাররাহ রাহ. ইবনে উয়াইনা রাহ.-এর শাগরিদ ছিলেন। তিনি বর্ণনা করেন, সুফিয়ানের আম্মা তাকে বললেন, তুমি ইলমে দ্বীন শেখো। সুতা কেটে হলেও তোমার প্রয়োজন পুরা করব। তুমি দশটি হাদীস শেখার পর ভেবে দেখবে নিজের চাল-চলনে গাম্ভীর্য ও সহনশীলতা এসেছে কি না। এমন না হলে এই ইলম তোমার জন্য ক্ষতিকর, উপকারী নয়। —তারিখে জুরজান ১/ ৪৭৬
মায়ের বিশেষ দৃষ্টি ও নসীহত অনুযায়ী ইমাম ইবনে উয়াইনা সাতাশি থেকেও বেশি উলামায়ে তাবেয়ীন থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁকে শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসগণের মধ্যে গণ্য করা হয়।
আওযায়ী রাহ.-এর আম্মা
শায়খুল ইসলাম ইমাম আওযায়ী রাহ.-এর নাম আবদুর রাহমান ইবনে আমর ইবনে মুহাম্মাদ আওযায়ী। তাঁর ফিকহী মাযহাব তৃতীয় হিজরী শতাব্দী পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। আশি হাজার মাসআলার জবাব মুখেই দিয়েছেন। আলেমে রব্বানী ছিলেন। এ সবই ছিল তাঁর মায়ের তালীম-তরবিয়তের ফল।
এতীম ছিলেন। মা-ই লালন-পালন করেছেন। তাঁর উৎসাহ-প্রেরণা ও মেহনত-মুজাহাদার দরুন তিনি পৌঁছেছিলেন শায়খুল ইসলামের মর্যাদায়। তাঁর ব্যাপারে বলা হয়েছে, তাঁর মা তাঁকে এমনভাবে তরবিয়ত করেছেন, আদব শিখিয়েছেন যে, রাজা-বাদশারা নিজ সন্তানদেরকে এমন আদব শিক্ষা দিতে অক্ষম। —তাযকিরাতুল হুফফাজ ১/১৩৫
ইবনে উলায়্যাহ রাহ.-এর আম্মা
ইবনে উলায়্যাহ রাহ.-এর নাম হল, ইসমাঈল ইবনে ইবরাহীম। তিনি ফুকাহা এবং মুহাদ্দিসীনের ইমাম। তার মায়ের সাথে সম্পৃক্ত করে তাকে ইবনে উলায়্যাহ বলা হয়। এ নামেই তিনি প্রসিদ্ধ।
ইবনে উলায়্যাহর মা উলায়্যাহ ছিলেন একজন কৃতদাসী। তবাকাত ইবনে সা‘দ-এ (৫/৩১৭) তাঁর ব্যাপারে বলা হয়েছে, তিনি বড় সম্মানীত, জ্ঞানী, মেধাবী নারী ছিলেন। বছরার উক্বা মহল্লায় এক জায়গা তার নামেই প্রসিদ্ধ ছিল। বসরার ছালেহ মুররী এবং বড় বড় ফকীহ সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ তাঁর ওখানে যেতেন। পর্দার আড়াল থেকে তিনি তাঁদের সঙ্গে দ্বীনী ও ইলমী মাসআলা নিয়ে আলোচনা করতেন।
এই আলেমা ফাযেলা নারীর গর্ভ থেকেই জন্মগ্রহণ করেন (১১০ হি.) ইমাম ইসমাঈল বছরী। যিনি মায়ের তা‘লীম ও তরবিয়াত-এর মাধ্যমে ফুকাহা এবং মুহাদ্দিসীনের ইমাম হয়ে গেছেন।
প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আবদুল ওয়ারিস বর্ণনা করেন, উলায়্যাহ বিনতে হাসসান তাঁর ছেলে ইসমাঈলকে আমার কাছে নিয়ে এলেন। সে অনেক সুশ্রী ছিল। বললেন, আমার এই ছেলেটি আপনার কাছে থাকবে। আপনার থেকে আখলাক শিখবে। ইমাম আবদুল ওয়ারিস বর্ণনা করেন, আমি তাকে আমার কাছে রাখলাম। যখন কোনো আহলে ইলমের মজলিসে যেতাম, তখন তাকে আগে প্রেরণ করতাম, তারপর আমি মজলিসের শায়খের কাছে যেতাম।
সেই যামানায় গোলাম-বাঁদি পর্যন্ত ইলমে দ্বীন সম্পর্কে এত উঁচু পর্যায়ের রুচি রাখতেন! তাদের ইলমী এবং দ্বীনী জিন্দেগীও ছিল অনেক উঁচু মানের।
উলায়্যাহর তিন সন্তান ছিল। ইসমাঈল, হাম্মাদ, মুহাম্মাদ। মায়ের দিকে নিসবত করে তাদের ইবনে উলায়্যাহ ডাকা হত। তিন ভাই-ই মায়ের উন্নত তরবিয়তের ফলে যামানার প্রসিদ্ধ আলেম-ফাযেল হিসেবে বরিত হয়েছেন। —তারিখে বাগদাদ ৫/১৭১
আবুল ওয়ালীদ হাসসান বিন মুহাম্মাদ আলকুরাশীর আম্মা
আবুল ওয়ালীদ হাসসান বিন মুহাম্মাদ বিন আহমাদ বিন হারুন আলকুরাশী (মৃত্যু : ৩৪৯ হি.) খুরাসানের বিজ্ঞ এক ফকীহ ছিলেন। মুহাদ্দিসীনের ইমাম এবং যুহদ ও ইবাদতে অগ্রগামী ছিলেন। তিনি তার অন্তিম শয্যায় বর্ণনা করেন, আমার আম্মা আমাকে বলেছেন,যখন তুমি আমার গর্ভে ছিলে তখন ইমাম আব্বাস বিন হামযার দরসের মজলিস হত। আমি তোমার আব্বার কাছে দশ দিন পর্যন্ত সে মজলিসে হাযির হওয়ার অনুমতি চাইলাম। তিনি অনুমতি দিলেন। দশ দিনের দিন মজলিস শেষ হলে ইমাম আব্বাস বিন হামযা উপস্থিত সবাইকে দাঁড়াতে বললেন। সবাই দাঁড়িয়ে গেল। আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম। তিনি দুআ শুরু করলেন। তখন আমি আল্লাহর কাছে দুআ করলাম, আল্লাহ যেন আমাকে আলেম ছেলে দান করেন।
ঘরে এসে রাতে স্বপ্নে দেখলাম, এক লোক আমার কাছে এসে বলছে, তোমার জন্য সুসংবাদ; আল্লাহ তাআলা তোমার দুআ কবুল করেছেন। —তবাকাতুশ শাফিইয়্যাহ ২/১৭০
এই ঘটনা বলার চার দিন পর হাসসান বিন আহমাদ কুরাশী ৩৪৯ হিজরীর ৫ই রবিউল আউয়াল জুমার রাতে ইন্তেকাল করেন।
যাইনুদ্দীন আবুল হাসান আলী ইবনে ইবরাহীম রাহ.-এর আম্মা
যাইনুদ্দীন আবুল হাসান আলী ইবনে ইবরাহীম দিমাশকী (মৃত্যু : ৭ রমযান ৫৯৯ হিজরী)। একজন বিজ্ঞ ফকীহ, ওয়ায়েয ও তাফসীরবিদ ছিলেন। এ সবকিছুই তিনি অর্জন করেছেন, তার মায়ের দুআর বরকতে। যিনি নিজেও একজন নেককার কুরআনের হাফেযা এবং মুফাসসির ছিলেন।
নাসীহুদ্দীন বর্ণনা করেন,যাইনুদ্দীন তাঁর মায়ের বরকতে এই মর্যাদায় উন্নীত হয়েছেন। তাঁর মা একজন হাফেযে কুরআন এবং তাফসীর জানা মানুষ ছিলেন।
ইমাম যাইনুদ্দীন বর্ণনা করেন, যখন আমার মামা ইমাম শরফুল ইসলাম আবদুল ওয়াহহাব-এর কাছ থেকে তাফসীর পড়ে আম্মাজানের কাছে যেতাম তখন তিনি জিজ্ঞাসা করতেন, ভাই আজ কী তাফসীর করেছেন?
আমি বলতাম, অমুক অমুক সূরার তাফসীর করেছেন।
তখন তিনি বলতেন, অমুকের বর্ণনা নকল করেছেন? অমুক বিষয়টি বয়ান করেছেন?
আমি বলতাম, না।
তখন তিনি সেটা বর্ণনা করে বলতেন, এটা তো ছেড়ে দিয়েছে।
তাঁর অবস্থা তো ছিল এমন, তিনি তাঁর পিতার ৩০ খণ্ডে লিখিত তাফসীরে কিতাবুল জাওয়াহির মুখস্থ করেন ।
তবাকাতুল মুফাসসিরীনের মধ্যে ঘটনাটি এভাবে লেখা হয়েছে, শায়খুল ইসলাম ইমাম আবুল ফারাজ আবদুল ওয়াহীদ বিন মুহাম্মাদ শীরাযী (মৃত্যু : ৪৮৬ হি.) কিতাবুল জাওয়াহির নামে ৩০ খণ্ডে কুরআনের তাফসীর লিখেছেন। এই পুরা কিতাব তাঁর মেয়ের মুখস্থ ছিল। —তবাকাতুল হানাবিলা ৩/৪৩৬-৪৪০