নারীর মূল্যবান সময়
মায়মূনা
সচেতন মুসলিম নারীর কাছে সময়ের গুরুত্ব অনেক। তাই অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে সময় নষ্ট করা তার কাছে অপছন্দনীয়। সে জানে, অহেতুক বিষয় এড়িয়ে চলা ইসলামের সৌন্দর্য। সময় হচ্ছে হারিয়ে যাওয়া নিশ্বাসের নাম, যা কোনোভাবে ফিরিয়ে আনা যায় না। মুসলিম নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক ব্যাপক ও গুরুত্বপূর্ণ। তাই নফস আর শয়তান বিভিন্ন অহেতুক বিষয়ে নারীদের ব্যস্ত রাখতে চেষ্টা করে। হিংসা-বিদ্বেষ, গীবত, দোষ চর্চা, চোগলখুরি ইত্যাদিতে লিপ্ত করে দেয়। এসব ছাড়া যেন আমাদের সময় কাটে না!
আমরা নারীরা একত্রিত হলেই গীবতের মাধ্যমে আনন্দ খুঁজি; অথচ আমাদের পূর্বসূরিরা একত্রিত হলে দ্বীনী আলোচনায় একে-অপরকে আলোকিত করতেন। গীবত করে, অন্যের দোষ চর্চা করে এত সময় আমাদের নষ্ট হয়ে যায়— ভাবলে সচেতন নারীমাত্রই আতঙ্কিত হবেন। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে একটি গোনাহ বারবার করতে করতে এটিকে আর গোনাহ মনে হয় না। গীবত করাকে সবাই গোনাহ বলে স্বীকার করলেও সময় নষ্ট করা যে গোনাহ— এটা অনেকের বুঝে আসে না। সময় নষ্ট করার গোনাহে আমরা নারীরা এতটা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে, তা নিয়ে আমাদের ভাববারও ফুরসত হয় না। আসুন, নিম্নোল্লিখিত আয়াতটি বারবার তিলাওয়াত করি এবং একটু ভাবি, কতটা মমতার সঙ্গে আল্লাহ পাক আমাদের জিজ্ঞেস করছেন—
اَفَحَسِبْتُمْ اَنَّمَا خَلَقْنٰكُمْ عَبَثًا وَّ اَنَّكُمْ اِلَیْنَا لَا تُرْجَعُوْنَ.
তোমরা কি ধারণা কর যে, তোমাদের অযথা সৃষ্টি করা হয়েছে আর তোমরা আমার কাছে ফিরে আসবে না? —সূরা মুমিনূন (২৪) : ১১৫
কিন্তু বেলা ফুরিয়ে গেলে কি সুযোগ থাকে। মুসলিম নারীর সময় কি এতই মূল্যহীন যে অন্যের গীবত ও দোষচর্চার মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় হয়ে যাবে! আজকাল তো সময় কাটানো, গল্পের আসর জমানোর জন্য গীবতের সংজ্ঞা পরিবর্তন করা হয়। প্রত্যেকে নিজ নিজ প্রয়োজনে গীবতকে হালাল বানিয়ে তারপর স্বাদ নিতে শুরু করে। অনেকে গীবতের মজলিস ভাঙতে এসে অনিচ্ছায় গীবত শুনতে থাকেন। এজন্যই বলা হয়েছে, গীবত শুরু হতে গেলেই থামিয়ে দাও। কারণ শয়তান এই মজলিসের বিশেষ ইন্তেযাম করে এবং মধুময় স্বাদ বিতরণ করে, তাই বেশিরভাগ মানুষই সে মজলিস ভাঙতে দ্বিধায় ভোগেন। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কতটা উৎসাহ দিয়ে বলেছেন—
مَنْ ذَبَّ عَنْ لَحْمِ أَخِيهِ فِي الْغَيبَةِ كَانَ حَقًّا عَلَى اللَّهِ أَنْ يُعْتِقَهُ مِنَ النَّارِ.
যে মানুষকে আরেক ভাইয়ের গীবত থেকে বিরত রাখবে তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়ার দায়িত্ব আল্লাহর উপর। —মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৬৯৯৮
নারীরা এই বাণীটি আত্মস্থ করত পারলে অনেক ধরনের সামাজিক ফাসাদ থেকে বেঁচে থাকতে পারবেন।
গীবত শুধু নিজে করলেই অপরাধী হয় না, কাউকে করার সুযোগ দিলেও সমান অপরাধী হতে হয়। অহেতুক কাজ-কর্ম ও অপ্রয়োজনীয় বিষয়াদি এড়িয়ে চলতে মুসলিম নারী যে কর্মপন্থা অবলম্বন করতে পারে তা হল, প্রথমেই স্থির হয়ে একটু ভাবুন, মহান সৃষ্টিকর্তা কেন আপনাকে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। এই মূল্যবান সময় তো অন্যের দোষ চর্চা করে কাটানোর জন্য তিনি দেননি। একজন মুসলিম নারী হিসেবে কি আপনাকে মানায় যে আপনি এত সস্তায় আপনার মূল্যবান সময় অন্যের পেছনে খরচ করবেন; তাও আবার নিজের ক্ষতি করে?
আপনি তো বুদ্ধিমতী ও সচেতন। আপনি তো উম্মুল মুমিনীন খাদিজা রা.-এর উত্তরসূরি, যাঁর মাধ্যমে ইসলাম নামক বৃক্ষ সজীবতা লাভ করেছে। আপনি তো জ্ঞানতাপসী উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা.-এর মানসকন্যা, যার মাধ্যমে মুসলিমদের জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে। আপনি তো সমাজের অর্ধাংশের প্রতিনিধিত্বকারী এবং বাকি অংশের নির্মাণের দায়িত্বও আপনার উপর। আপনার হাতেই তো তৈরি হবে ইসলামের বীর-বীরঙ্গনারা। সুতরাং আপনার সময় মহামূল্যবান। আপনার সময়গুলো হেলায় নষ্ট হয়ে গেলে সমাজের হাল ধরবে কে? আপনার দায়িত্ব অনেক, এ দায়িত্বে অবহেলা করলে প্রজন্ম হয়ে যাবে নীড়হারা!
কিছু বিষয় আমরা মুযাকারা করতে পারি, যার মাধ্যমে আমরা বেঁচে থাকতে পারি অহেতুক কাজকর্ম থেকে :
এক. নিয়মিত দ্বীনী বই পড়–ন। বইয়ের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তুলুন।
দুই. দু-চার জন নারী একত্রিত হলে কোনো প্রকার দুনিয়াবী আলোচনা না করে দ্বীনী আলোচনা করুন।
তিন. নিজ নিজ জায়গা থেকে দাওয়াতী কাজে লেগে থাকুন। সমাজকে ভালোবাসুন, সমাজের কল্যাণে নিবেদিত হোন।
চার. মুসলিম নারীদের দ্বীনী অবস্থা নিয়ে চিন্তা-ফিকির করুন, দ্বীনী কাজে তাদের উৎসাহিত করুন।
পাঁচ. আশ-পাশের নারীদের দ্বীনী চেতনায় উজ্জীবিত করুন, সচেতনতা সৃষ্টি করুন, যাতে তারাও অযথা সময় নষ্ট করা থেকে বেঁচে থাকতে পারে।
ছয়. আপনার সাধ্যের মধ্যে আপনার প্রতিবেশী নারীদের দ্বীন শিক্ষার ব্যবস্থা করুন।
সাত. বেশি বেশি ইস্তেগফারের অভ্যাস করুন। এর নগদ ফায়েদা হল, ছোট ছোট গোনাহও বড় মনে হতে থাকবে। বেশি বেশি তওবার তাওফীক হবে। হাদীস শরীফে আছে, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একেক মজলিসে একশ বারের বেশি ইস্তেগফার করতেন।
পরিশেষে বলব, সময় ও জীবন আপনার, তাই জীবনকে সুন্দর ও কর্মময় করে সাজিয়ে নিন, যাতে নফস ও শয়তান ধোঁকা দেয়ার সুযোগ না পায়। মুসলিম উম্মাহর এই ক্রান্তিকালে আপনি যদি দায়িত্ব ভুলে গাফিলতির চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকেন তাহলে কীভাবে আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যার প্রতীক্ষায় উম্মাহর প্রতিটি সদস্য সদা উদগ্রীব ও ব্যাকুল।
আল্লাহ আমাকে-আপনাকে সময়ের কদর করার তাওফীক দিন। সময়কে নিজের দ্বীনী উন্নতি ও অন্যান্য নারীদের দ্বীনী উন্নতির কাজে ব্যয় করার তাওফীক দান করুন— আমীন।